Sunday, October 21, 2012

রামুতে লুণ্ঠিত তিনশ’বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার হয়নি


Details


লেখক: রফিকুলইসলাম সেলিম, চট্টগ্রাম অফিস  |  রবিবার, ২১ অক্টোবর ২০১২

কক্সবাজারের রামুর বিভিন্ন বিহার থেকে লুণ্ঠিত তিন শতাধিক বুদ্ধমূর্তি, বুদ্ধের কেশ-দন্ত-অস্থিধাতুসহ হাজার বছরের পুরনো অনেক বিরল নিদর্শন উদ্ধার হয়নি। কোটি কোটি টাকা দামের এসব নিদর্শন উদ্ধারে গত ২০ দিনেও বিশেষ কোন অভিযান পরিচালিত হয়নি। ফলে লুণ্ঠিত এসব মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও শতাধিক বসতিতে হামলা হয়। এর পরদিন উখিয়া এবং টেকনাফেও বৌদ্ধ বিহার এবং পল্লীতে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট হয়। এসব ঘটনায় ১৭টি মামলায় ২২৫ জনকে গ্রেফতার করা হলেও গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত লুণ্ঠিত কোন বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার করা হয়নি।
বিষয়টি স্বীকার করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর ইত্তেফাককে বলেন, বৌদ্ধ বিহার বসতিতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। এসব ঘটনায় নিয়মিত আসামি ধরা পড়লেও কোন বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার হয়নি। ঘটনার পরদিন থেকে চলমান অভিযানে বুদ্ধমূর্তিসহ লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা অভিযান তদারকি করছেন। বুদ্ধমূর্তি উদ্ধারে খুব শিগগির বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও জানান তিনি।
সহিংসতার পর বিহার পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে লুণ্ঠিত ও ধংসপ্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তিসহ ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রশাসনকে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার করার আশ্বাসও দেয়া হয়। তবে এখনও লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার না হওয়ায় বিহারগুলোতে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বৌদ্ধ সমিতির নেতাদের হিসাবমতে, রামুর ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি বিহার থেকে প্রায় ৩০০ প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি চুরি হয়েছে। লুণ্ঠিত বুদ্ধমূর্তির মধ্যে রয়েছে ৬০০ বছরের পুরাতন একটি এক কেজি ওজনের স্বর্ণের মূর্তি এবং এক ফুট লম্বা একটি কষ্টি পাথরের দামি মূর্তি। এছাড়াও রূপা, শ্বেতপাথর ও অষ্টধাতুসহ কয়েকটি দামি বুদ্ধমূর্তিও লুণ্ঠিত হয়েছে।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার পরিচালনা কমিটির সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া বলেন, কেন্দ ীয় সীমা বিহার ছিল প্রাচীন এবং মূল্যবান বুদ্ধমূর্তিতে সমৃদ্ধ। দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ এবং ভাংচুরের আগে বিহার থেকে দু’টি স্বর্ণমূর্তিসহ বিপুল দামি মূর্তি লুট করেছে। অন্য বিহারগুলোতেও অগ্নিসংযোগের আগে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। জানা যায়, উত্তর মিঠাছড়ি জোয়ারিয়ানালার বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দে র শতফুট দীর্ঘ সিংহশয্যা বুদ্ধমূর্তির সামনে রাখা পিতলের দানবাক্স ভেঙে সেখান থেকে টাকা লুট করা হয়। বিহারের ভিক্ষু শ্রীমত্ করুণাশ্রী বলেন, পুরাতন মন্দিরে রাখা বেশ কয়েকটি দামি মূর্তিও লুট করে হামলাকারীরা। রামুর শ্রীকুল গ্রামের সাদা সিং বিহার থেকে শ্বেতপাথরের ৫টি বুদ্ধমূর্তি চুরি করা হয়। লুট করা হয় বিহারে রাখা দু’টি দানবাক্স। বাকি মূর্তি ও নিদর্শন ধ্বংস করা হয়। একই এলাকার লাল সিং বিহারেও ব্যাপক লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
প্রশাসনকে দেয়া তালিকা থেকে জানা যায়, বড় বৌদ্ধ বিহার হিসাবে পরিচিত রামুর হাইটুপী গ্রামের উসাই-ছেন রাখাইন বিহার (বড় ক্যাং) থেকে ১ কেজি ওজনের একটি স্বর্ণের বুদ্ধমূর্তি, কষ্টি পাথরের এক ফুট লম্বা একটি মূর্তি, ১০০ গ্রাম ওজনের ৩০টি এবং ২০০ গ্রাম ওজনের ৩০টিসহ মোট ৬০টি রূপার মূর্তি এবং দেড় ফুট লম্বা তিনটি পিতলের মূর্তি লুট হয়। এছাড়া ১৫০ গ্রাম ওজনের ৩০ বৌদ্ধ রূপা ফুলের টপ, বুদ্ধের ১টি দন্তধাতু, ২টি কেশধাতু চুরি হয়। বিহারের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাদীপ্ত মহাথের বলেন, আগুন না দিলেও সবচেয়ে বেশি লুটপাট করা হয়েছে এই বিহার থেকে। উত্তর মিঠাছড়ির ৫০০ বছরের পুরাতন প্রজ্ঞামিত্র বন বিহারের শিক্ষার্থী রতন মিত্র শ্রমণ ও বাপ্পী বড়ুয়া শ্রমণ জানায়, তাদের বিহারে অগ্নিসংযোগের আগে হামলাকারীরা লুটপাট চালায়। তারা প্রধান ভিক্ষুর কক্ষে রক্ষিত দুধ, চিনি এমনকি কাপড়-চোপড় পর্যন্ত লুট করে। লুটপাট ছাড়াও অগ্নিসংযোগের ফলে পুড়ে গেছে আরও কয়েকশ’ মূর্তি। শত শত মূর্তিকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। অধিকাংশ মূর্তি পিতল, শ্বেত পাথর ও কষ্টি পাথরের হওয়ায় আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও এগুলোর ধংসাবশেষ থেকে গেছে। বুদ্ধমূর্তির পাশাপাশি রামুর ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলোতে রক্ষিত ছিল বাংলা, ইংরেজি, বার্মিজ, পালি ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষার বিপুল সংখ্যক ত্রিপিটক। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে আনা তালপাতা এবং কাঠে খচিত বিরল ত্রিপিটকও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মো. নূরুল আমিন ইত্তেফাককে বলেন, রামু থানায় দায়েরকৃত ৮টি মামলাতেই বিহারে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটপাট ও মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হলেও কোন বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার করা যায়নি। তিনি বলেন, অভিযানকালে বিদ্যুতের তারসহ কিছু সামগ্রী উদ্ধার হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত দামি কোন বস্তু উদ্ধার হয়নি। প্রতিরাতে অভিযান চলছে।

No comments:

Post a Comment