Thursday, October 18, 2012

নেত্রহীন বুদ্ধ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অন্ধ


মামুনুর রশীদ | তারিখ: ১৯-১০-২০১২

  ছোটবেলা থেকেই গৌতম বুদ্ধের চোখ দুটো আমাদের আকৃষ্ট করত। স্থির-নিশ্চল কিন্তু আহ্বানভরা চোখ দুটি যেন কথা বলত। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখ দুটো যেন নড়তে শুরু করত। সেই চোখ দুটো যখন উধাও হয়ে যায় বুদ্ধের মূর্তি থেকে, তখন কেমন লাগে? রীতিমতো ভয় লাগে—কল্পনায় দেখতে থাকি অনেক কিছু; থিয়েটারের ছাত্র হিসেবে মনে পড়ে ইদিপাসের চোখ দুটো। সে চোখ আমরা দেখিনি, কিন্তু কল্পনা করতে পারি শলাকাবিদ্ধ চোখ দুটো কেমনই বা হতে পারে। কিন্তু উখিয়া বা রামুতে কল্পনা করতে হয়নি। দুই চোখ তুলে নেওয়ার পর গৌতম বুদ্ধকে কেমন দেখায়? কী অসহায় নেত্রহীন গৌতম বুদ্ধ। রামু, উখিয়াতে গিয়েছিলাম ধ্বংসযজ্ঞ দেখার জন্য, কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে নেত্রহীন গৌতম বুদ্ধের মূর্তি দেখে চমকে উঠলাম, বিষণ্ন হয়ে গেলাম। মনের মধ্যে প্রশ্ন, কেন গৌতম বুদ্ধের চোখ জোড়া ওদের টার্গেটে পরিণত হলো? যদিও এক জায়গায় ছিন্নমস্তক বুদ্ধকেও দেখতে পেলাম। একজন অবশ্য বলল, চোখটা যে ধাতু দিয়ে তৈরি হয়, তা নাকি সবচেয়ে মূল্যবান। লুটেরাদের কাছে তা সত্যি মূল্যবান মনে হয়েছে।বুদ্ধের যে শায়িত মূর্তিটি আছে, ১০০ ফুট যার দৈর্ঘ্য— বিশাল হাতুড়ি দিয়ে তার ওপর আক্রমণ। আক্রমণের ফলে ফাটল ধরেছে, কিন্তু ভেঙে চুরমার করতে পারেনি। রামুর বড় মন্দিরটির হাজার বছরের পুরোনো পাণ্ডুলিপিগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৮৩ বছরের বৃদ্ধ ভান্তে বললেন, ‘আমার এত বছরের সাধনা শেষ হয়ে গেল।’ তিনি হস্তলিপি ও পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের একজন বিশেষজ্ঞ। ওই সব লিপিতে যা ছিল তা তিনি অনুবাদও করেছেন। সব পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
ভান্তেরা প্রাণে বেঁচেছেন, লুকিয়ে বেঁচেছেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষজনও প্রাণে বেঁচেছেন, লুণ্ঠিত হয়েছে তাঁদের সম্পদ। একটি ভিত্তিহীন ফেসবুকের ছবিকে কেন্দ্র করেই কি শুধু তাণ্ডব সৃষ্টি করা হলো? তাহলে বুদ্ধের চোখ উপড়ে ফেলা, হাজার বছরের তাম্রলিপি, পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করা? নানা প্রশ্ন মনে জাগছে।
গৌতম বুদ্ধ তো মানুষ, রক্ত-মাংসের মানুষ। তিনি অহিংসার বাণী নিয়ে এসেছিলেন, যখন হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী। পৃথিবীর এই ক্রান্তিকালেই মহামানবদের আবির্ভাব হয়। এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁর প্রভাব। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে তাঁর বাণী এসে পৌঁছেছিল। বিপুলসংখ্যক আদিবাসী ও বাঙালি এই ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে হাজার বছর ধরে চলছিল তাদের জীবনযাপন। কিয়াংয়ের ঘণ্টাধ্বনি শান্তির সুবাতাস বয়ে আনত। মসজিদ, মন্দির, গির্জা আর কিয়াংয়ের সম্মিলিত আহ্বানে মানুষ শান্তিতে বসবাস করত।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই অশান্ত হয়ে পড়ে পার্বত্য অঞ্চল। বারবারই বারুদের গন্ধে পরিবেশ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বৌদ্ধবিহার বা মন্দির কখনো আক্রান্ত হয়নি। এমনকি একাত্তরে নিষ্ঠুর পাকিস্তান সেনাবাহিনীও এসব মন্দিরে আক্রমণ করেনি। আমাদের গর্বের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভাগ্যে জুটল এক কলঙ্কতিলক। মনে পড়ে, হিন্দু শাসকেরা একদা বৌদ্ধবিহারকে আক্রমণ করেছিলেন, প্রায় কচুকাটা করেছিলেন। বৌদ্ধ ভান্তেরা তখন বাঁচার জন্য অস্ত্র ধারণের অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সে নির্দেশ মেলেনি। কারণ, বৌদ্ধদের অস্ত্র ধারণ মানেই তার ধর্মের পতন। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে বৌদ্ধদের। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা অবশ্য অস্ত্র ধারণ করেছিল, কিন্তু কোনো ভান্তে বা বৌদ্ধমন্দির কখনো অংশ নেয়নি। বাংলাদেশের বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপংকর সেই তিব্বতে গিয়ে ধর্ম প্রচারে যুক্ত হয়েছিলেন।
কেন এই বৌদ্ধবিহার আক্রমণ? এটা কি শুধু মুহূর্তের উত্তেজনা বা মৌলবাদী জঙ্গিদের পরিকল্পনার অংশ? জবাব মেলে না। বিএনপির সাংসদের একক উদ্যোগ? আওয়ামী লীগের লোকদের আড়াল করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য? সম্প্রতি মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের প্রতিশোধ? বিষয়টি অনেক অনুসন্ধানের অপেক্ষা রাখে। নিজেকে প্রশ্ন করতেই বুকটা হু হু করে ওঠে। যে মৌল আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেখান থেকে কত দূরে সরে এসেছি আমরা?
দীর্ঘ সেনাশাসন, এর মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ, বারবার সংবিধান ক্ষতবিক্ষত হওয়া, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের সংযোজন, মাদ্রাসা শিক্ষার নামে তৎপর বিভিন্ন গোষ্ঠীর কার্যকলাপ—এসবের মধ্যে দিয়ে কী ঘটেছে? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রক্তের মধ্যে একটা সাম্প্রদায়িক চেতনা কি প্রোথিত হয়ে যায়নি? এসবের জবাব কী? দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থায় ভোটের রাজনীতিও কি যুক্ত হয়নি? বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণে একটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে যায়নি? উখিয়াতে উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা চৌধুরী সাহেব মাত্র আটজন লোক নিয়ে শটগানের ২২টি গুলি ফুরিয়ে কি তিনি বৌদ্ধমন্দিরকে রক্ষা করেননি? রামুতে সরকারদলীয় কর্মীরা কী করলেন? প্রশাসন কী করল?
একটা উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ে সব নেতা-কর্মী একসঙ্গেই বসেন, কথা বলেন, সব সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। এত বড় একটা ঘটনা কী করে ঘটল যে সবাই জানতে পারল না? ভাবতে অবাক লাগে। শত শত লোক অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনে অংশ নিল, তারা কি শুধুই একজোটভুক্ত? তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে অন্য জোট তাদের প্রতিরোধ করল না কেন?
অবাক লাগে, যখন প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে বিএনপির নেতা বলেন। মওদুদ আহমদ প্রথমে আওয়ামী লীগ, পরে বিএনপি, পরে জাতীয় পার্টি এবং বর্তমানে বিএনপিতে। একজীবনে তিনি কতগুলো দলের নেতা হন? তাঁকে কোন দলের নেতা বলব? এই চরিত্রই বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে না? জনগণও কি এই চরিত্র অর্জন করছে?
একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে জনগণও আদর্শিক জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। তাই একটা সুবিধামতো অবস্থানই নিয়ে নিচ্ছে, সে অবস্থান কতটা আদর্শিক, কতটা অসাম্প্রদায়িক—তা খোঁজার তোয়াক্কা করছে না। উখিয়ার চৌধুরী সাহেব কেন এই ঝুঁকি নিলেন, তা-ও প্রশ্ন জাগে।
রামুতে গান পাউডার, পেট্রল নিয়ে যে সহিংসতা ঘটিয়েছে, তা রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক বিবৃতিতে শেষ হওয়া উচিত নয়। যশোরে উদীচীর বোমা হামলা, রমনার বটমূলে আক্রমণ, কমিউনিস্ট পার্টির পল্টনের ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়নি। শেখ হাসিনার প্রাণনাশে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার পুরো রহস্য এখনো ভেদ হয়নি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডেরও কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান হয়নি। কেন? তদন্তকারী দলগুলো কি নানা ধরনের রাজনৈতিক চাপে বিভ্রান্ত? তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে নাগরিকদের জীবন কতটা অনিশ্চিত! দেশটা কি তাহলে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে সত্য অনুসন্ধান থেকে বিরত থাকবে?
কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলকে এক জায়গায় থেকে সত্য অনুসন্ধান প্রয়োজন। দুর্ভাগ্য, সে সংস্কৃতি আমাদের দেশে এখনো অবর্তমান। এসবের পরিণতিও বড় নাশকতাপূর্ণ কর্মকাণ্ড। উখিয়া, রামু, পটিয়ার ঘটনা আমাদের বৈদেশিক নীতির ওপর বড় রকমের প্রভাব ফেলবে। আমাদের অসাম্প্রদায়িক ও তথাকথিত মডারেট মুসলিম স্টেটকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত, কিন্তু ভেঙে যাওয়া অসাম্প্রদায়িক সমাজকে মেরামত করাও প্রয়োজন। চারদলীয় জোটের উসকে দেওয়া রাজনীতি এবং মহাজোটের পাল্টা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভোটের রাজনীতির একটা কূলকিনারা হতে পারে, কিন্তু কী হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ?
রামু থেকে ফিরে আসার পর একটা প্রশ্নই বারবার আমার এবং আমার সহযাত্রীদের বিদ্ধ করছিল যে আমরা কি সত্যিই সংখ্যালঘু? আমরা কি একেবারেই সমাজ-বিচ্ছিন্ন? সমাজের ভাবনাটা আমরা ধরতে পারছি না? সমাজটা কি ৪০ বছর পর একটা সাম্প্রদায়িক জায়গায় চলে এসেছে?
আমাদের দৌড় কি জাদুঘরের সামনে থেকে টিএসসি—বড়জোর শহীদ মিনার পর্যন্ত?
সবকিছু ছাপিয়ে গৌতম বুদ্ধের নেত্রহীন দেহটাকেই মনে পড়ছে। আমরাও তৃতীয় নয়নহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছি? অথবা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অন্ধ?
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।



যারা হামলা প্রতিরোধ করেছিলেন তাদেরও আসামি করা হচ্ছে

লেখক: কক্সবাজারপ্রতিনিধি  |  শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর ২০১২, ৪ কার্তিক ১৪১৯
উখিয়ার ঘটনায় মন্দির কমিটির হলফনামা
উখিয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশের গ্রেফতার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। এবার খোদ মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হলফনামা মূলে দাবি করেছেন, যে মুসলিম ব্যবসায়ী বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষায় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন তাকেও ভাংচুর মামলার আসামি করে জেল হাজতে প্রেরণের ঘটনায় তারা বিস্মিত।
বৃহস্পতিবার দুুপুরে কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে লিখিত হলফনামা দাখিল করেন হামলার শিকার পশ্চিম রত্না শাসন তীর্থ সুদর্শন বিহারের সভাপতি মধুসূধন বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক প্রশন্ত বড়ুয়া। হলফনামায় তারা দাবি করেন, বিহারের আশপাশের দোকানের মালিক ও ভাড়াটিয়াদের তারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। বিহারের পাশের হাজী আলী হোসেন মার্কেটের মালিক দরবেশ আলীকেও তারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। ওই ব্যবসায়ী বড়ুয়া (বৌদ্ধ) সম্প্রদায়ের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছিলেন এবং তাদের বিপদে-আপদে সবসময়ই এগিয়ে যেতেন। মধুসূধন বড়ুয়া ও প্রশন্ত বড়ুয়া আদালতকে বলেন, ‘৩০ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে দুর্বৃত্তরা মিছিল সহকারে সুদর্শন বিহারে হামলা করলে ব্যবসায়ী দরবেশ আলী বিহার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা  পালন করেছিলেন।’
আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবু ওবাইদা হলফনামা দু’টি নথিভুক্ত করে অধিকতর শুনানির জন্য আগামী ২২ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামু বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ বসতিতে এবং পরদিন উখিয়া ও টেকনাফে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনায় গত বুধবার পর্যন্ত ২০টি মামলায় নাম উল্লেখ করে ৩২১ জনসহ ১৫ সহস াধিক লোককে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মামলাগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষ আসামি হওয়ার সুযোগে অনেক গ্রাম্য দালাল সাধারণ মানুষকে পুলিশের মাধ্যমে আসামি করার কথা বলে হয়রানি করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিদেশিসহ ৩ সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদ
কক্সবাজারে এক বিদেশি সাংবাদিকসহ ৩ সংবাদকর্মীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। পুলিশ দাবি করেছে, ‘সন্দেহজনক’ভাবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করার অভিযোগে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে কয়েকঘণ্টা পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এরা হচ্ছেন নরওয়ে থেকে প্রকাশিত ‘অসলো টাইমস’ পত্রিকার প্রধান বার্তা সম্পাদক মুকতার হাফিদ, বাংলাদেশি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান হাসান ও মডেল প্রিয়া। বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে কক্সবাজার বিমান বন্দর থেকে তাদের আটক করা হয়। সন্ধ্যায় জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয়। তারা ঢাকায় ফিরে গেছেন। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, সন্দেহজনক গতিবিধির অভিযোগ পেয়েই ওই ৩ জনকে কক্সবাজার বিমান বন্দর থেকে পুলিশ হেফাজতে আনা হয়েছিল। তারা কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন।
তিনি জানান, জিজ্ঞাসাবাদে তারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রমাণ্যচিত্র তৈরির বিষয়টি জানিয়েছেন। তাদের পরিচয় এবং তথ্য যাচাইয়ের পর ছেড়ে দেয়া হয়।

শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর ২০১২
আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের প্রতিবেদন রামুতে প্রশাসন ছিল নির্বিকার
    স্টাফ রিপোর্টার: কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার, নির্লিপ্ত ও নেতৃত্ববিহীন ছিল বলে পরিদর্শন প্রতিবেদন দিয়েছে সরকার সমর্থক সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ। রামু, টেকনাফ এবং উখিয়া পরিদর্শন শেষে ঢাকা ফিরে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আইনজীবী পরিদর্শন দলের প্রতিবেদন তুলে ধরেন পরিষদের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই এলাকায় সংঘটিত ঘটনাগুলো নিছক ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাতের প্রতিফলন নয়। বরং ঘটনাগুলো পূর্বপরিকল্পিত এবং আক্রমণগুলো পূর্ব ধারণাকৃত। পুলিশ সুপারের ভাষ্য অনুযায়ী রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। সন্ধ্যা রাত থেকে এগারোটা পর্যন্ত তিনি মিটিং মিছিলের খবর পাচ্ছিলেন। ওসি পুলিশ সুপারকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু পুলিশ সুপার নিজে বা অন্য কোন এজেন্সি এ ব্যাপারে কোন তৎপরতা গ্রহণ করেছে বলে কোন তথ্য আমরা পাইনি। বরং ভুক্তভোগীরা টেলিফোনে যোগাযোগ করে ফোর্স পাঠানোর তাগিদ ও ১৪৪ ধারা বা কারফিউ জারি করার দাবি জানানো সত্ত্বেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি বলে সকলের অভিযোগ। এমনকি ফায়ার ব্রিগেডকে ফোন করে জানালেও তারা ওই সময়ে ঘটনাস্থলে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বলেন তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে কোন খবর পাননি। তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারে অবস্থানরত বিজিবি’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিজিবি জানায় তাদের নিযুক্ত হতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিষদের সদস্য সচিব সুব্রত চৌধুরী, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, সুপ্রিম  কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মোমতাজ উদ্দিন আহমদ মেহেদী, সাবেক সম্পাদক নুরুল ইসলাম সুজন এমপি, মো. মাহবুব আলী প্রমুখ।

শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর ২০১২, ৪ কার্তিক ১৪১৯

 হামলাকারীরা সংগঠিত হতে দীর্ঘ সময় পেয়েছে, প্রশাসন ব্যর্থ
০ পরিকল্পিত হামলা, বড় রকমের ষড়যন্ত্র
০ জামায়াত-বিএনপি ও রোহিঙ্গা উগ্রবাদীরা ছিল ঘটনার নেপথ্যে, আওয়ামী লীগের কিছু লোকও ধর্মীয় উত্তেজনায় সম্পৃক্ত হয়
০ সরকারী তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেশ
মোয়াজ্জেমুল হক/তপন বিশ্বাস ॥ দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা সময় ধরে সংগঠিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ বিহার-মন্দির ও তাদের বসতবাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। এ হামলার নেপথ্যে রয়েছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের মূল কারণ হচ্ছে, বর্তমান সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা। পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন এদেশে নিরাপদ নয়, এ ধরনের পরিস্থিতি বিদেশীদের নজরে আনা। এ ঘটনা নিয়ে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের ব্যর্থতা ছিল। কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক, রামুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক ব্যর্থতার জের হিসেবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা বৌদ্ধ মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার জঘন্য এ ঘটনা ঘটে। এদের ব্যর্থতা ও অবহেলা এমন ছিল যে, ওই সময়ের রামুর ঘটনার পর আরও দুটি পৃথক স্থানে একই ধরনের সহিংসতা ঘটেছে। এতে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা না হলেও কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তদন্ত কমিটি রামুর ঘটনার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান কাজলকে আংশিকভাবে দায়ী করেছে। এ ছাড়া যার ফেসবুকে পবিত্র কোরান অবমাননাকর ছবি ট্যাগ করা হয় সেই উত্তম কুমার বড়ুয়া, ছবি ডাউনলোডকারী এবং অবমাননাকর ছবি দেদার বিলি বণ্টনকারী আবদুল মুক্তাদিরসহ (বর্তমানে গ্রেফতারকৃত) ৩ যুবকের অপতৎপরতা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার শুরুতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ও কিছু কর্মী ধর্মীয় উত্তেজনায় উত্তেজিত হয়ে যোগ দেয়। রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিকল্পনায় যারা ছিল তারা ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত না হয়ে উত্তেজিতদের উস্কে দিয়েছে দেদার। সহিংসতার এ ঘটনায় স্থানীয় জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের উস্কানি ও সম্পৃক্ততা ছিল। এ ছাড়া ব্যক্তিগত আক্রোশ, জায়গা-জমি নিয়ে শত্রুতাসহ স্থানীয় বিভিন্ন বিরোধ এ হামলায় কাজ করেছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অনেকে প্রত্যক্ষভাবে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও আগুন দেয়ার ঘটনায় জড়িত রয়েছে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর সেখানকার রাখাইনদের হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের নানা ঘটনার জের। সংঘটিত ঘটনা নিয়ে প্রশাসনিক পর্যায়ের কারও বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা তুলে ধরা হয়নি। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কার কী ব্যর্থতা ছিল তা তুলে ধরা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুরো রিপোর্ট পর্যালোচনার পর সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তারা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তার ওপরই সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
সূত্রে জানানো হয়েছে, মূল রিপোর্ট ৬৫ পৃষ্ঠাসংবলিত। কিন্তু সাক্ষীদের জবানবন্দীসহ আনুষঙ্গিক নানা দালিলিক প্রমাণসংবলিত এ রিপোর্ট ৩শ’ পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে। এতে ২২ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। তন্মধ্যে কক্সবাজার অঞ্চলে মিয়ানমার থেকে আসা বৈধ এবং অবৈধ রোহিঙ্গাদের কার্যক্রম ও এনজিও তৎপরতার ওপর পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি করতেও সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তাদের কার্যক্রমে আরও শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা আরও জোরদার করার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
রিপোর্টে রামুর ঘটনার জন্য পুরোপুরিভাবে এমপিকে দায়ী করা হয়নি। তবে ছবি ডাউনলোডকারী আবদুল মুক্তাদির ফেসবুক থেকে ছবি প্রিন্ট করে নানাজনের কাছে দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করতে সহায়তা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মুক্তাদির ২০০০ সালের ১৭ জুলাই চট্টগ্রামে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর এইড মার্ডারের অন্যতম আসামি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা তোফায়েল আহমদের ভাগ্নে। সে চট্টগ্রামের শ্যামলী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র।
রামুর ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার দুপুরে তাদের রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র সচিবের দফতরে জমা দিয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল ইসলাম স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে এই রিপোর্ট প্রদান করেন। তদন্ত কমিটির অন্য কর্মকর্তারা হলেন, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার, এডিএম এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রামুর ঘটনা একটি বড় রকমের ষড়যন্ত্র। এই ঘটনার মাধ্যমে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা বা দাঙ্গা ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে রামুতে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালনো হয়। তিনটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মূলত এই হামলা চালানো হয়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচাল করা, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং আওয়ামী লীগ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থা নষ্ট করা। এমনিতে বিগত ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে জামায়াত-বিএনপির প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। সে কারণে তারা চায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারের আমলে এসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার হলে তারাও বলতে পারবে শুধু তারা নয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলেও সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটে। এতে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকে তারাও হানা দিতে পারবে।
মহাজোট সরকারের আমলেও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে চারদলীয় জোটের আস্থাভাজনরা। তারাও এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়ে ঘটনার সময় প্রশাসনকে রেখেছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এ সময় পুলিশ প্রশসানের পাশাপাশি সিভিল প্রশাসনও ছিল নীরব। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এ জাতীয় ঘটনা স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে কমিটি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্লিপ্ততার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট এলাকায়, ক্ষমতাসীনদের নেতৃত্বে ব্যাপক দুর্বলতা পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে জামায়াত-বিএনপি ও রোহিঙ্গাদের সরাসরি সক্রিয়তা পাওয়া গেছে।
সংঘটিত রামুর ঘটনা নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে স্থানীয় পুলিশ ও জেলা কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলার বিষয়টি। উত্তম কুমার বড়ুয়ার ফেসবুকে পবিত্র কোরান অবমাননাকর ছবিটি ঘটনার (২৯ সেপ্টম্বর) আগের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে ট্যাগ হয়ে ওই রাত অতিবাহিত হয়। পরে শুক্রবার পুরো একটি দিন ও রাত এবং সর্বশেষ শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অতিবাহিত হওয়া সময়ে কিছুই হয়নি। বিক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটে শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে।
এ ঘটনার নীলনকশা প্রণয়নকারীরা দীর্ঘ সময় পেয়েছে। কিন্তু এ ঘটনা এক মুখ থেকে বহু মুখ হয়ে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে প্রকাশ্যে। রামুর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রামুর অনতিদূরে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ নীরব ছিল। রামুতে প্রথম একটি মন্দির আক্রান্ত হওয়ার পর রামু থানা থেকে মাত্র ৪ পুলিশ পাঠানো হয়। রাত ৩টায় জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে অতিরিক্ত দাঙ্গা পুলিশ প্রেরণ করা হয় রামুতে। প্রশাসনের চরম অবহেলা ও দীর্ঘ সময় জুড়ে নির্লিপ্ততার কারণে নির্বিঘেœ ঘটনা ঘটিয়েছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্থান রামু। বছরের পর বছর এলাকায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন স্থানীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছেন। নীলনকশা প্রণয়নকারীরা মূলত অত্যন্ত কৌশলে এ ঘটনার জন্ম দিয়ে সফল হয়েছে। তারা উত্তম কুমার বড়ুয়ার ফেসবুকে ট্যাগ করা পবিত্র কোরান অবমাননার ছবিটি নিয়ে ব্যানার ফেস্টুন পর্যন্ত করিয়েছে। মানুষের মাঝে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে কোরান অবমাননার ছবিটি। এতে ধর্মান্ধ মানুষ ধীরে ধীরে ফুঁসে উঠেছে। বিক্ষোভ যখন একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় অর্থাৎ শনিবার সন্ধ্যার পর সাধারণ মানুষ চিৎকার করে সমবেত হতে থাকে আর এ সময়ে কমান্ডো স্টাইলে নীলনকশা বাস্তবায়ন হয়। একে একে রামুর ১৩ মন্দিরে আগুন, হামলা, লুটপাটসহ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনদের পল্লীতে তা-ব চালানো হয়। ইতোমধ্যে এ ঘটনার সঙ্গে কৌশলে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জঙ্গীদের ব্যবহার করা হয়েছে। স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতীদের ইন্ধন ছিল ব্যাপক।
রামুর ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটার উত্তরে রামু শহীদ সাহিত্য কমপ্লেক্সের সম্মুখস্থ প্রান্তিক ফিলিং স্টেশন থেকে বোতল ভর্তি পেট্রোল নিয়ে যায়। ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ শুক্রবার রামু বাজার এলাকার সাইফুল নামের এক যুবকের কম্পিউটার থেকে উত্তম কুমারের ফেসবুকে ট্যাগ করা পবিত্র কোরান অবমাননার অসংখ্য ছবি প্রিন্ট করে বের করা হয় যা বিক্ষুব্ধদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
সূত্র মতে, এ ঘটনা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। এর নেপথ্যে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির উগ্র একশ্রেণীর সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্তদের রয়েছে প্রণীত নীলনকশা। রামু, উখিয়া ও টেকনাফে গানপাউডার ও পেট্রোল দিয়ে বিহার, মন্দির ও বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনার কাজে জড়িতদের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের একটি অংশ। আর চট্টগ্রামের পটিয়ায় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে কর্মরত ইসলামী শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন সমর্থক নেতাকর্মীরা সরাসরি বিহার-মন্দির ভাংচুরে নেতৃত্ব ও উস্কানি দেয়ার তথ্য মিলেছে। নেতৃত্বদানকারীদের পরিচয় মিলেছে ওয়েস্টার্ন মেরিনের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিওচিত্রে।
খুবই সুস্থ ও ঠা-া মাথায় জঘন্যতম এ ঘটনা ঘটাতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনদের দুই ধরনের কথা বলে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো কাজ হয়েছে। একদিকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বোঝানো হয়েছে বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মিয়ানমারের রাখাইনদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে সেখানে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে পুনরায় অত্যাচার, নিপীড়ন ও জুলুম চালাবে এবং হত্যার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে নির্মূল করতে থাকবে। এ ধরনের ঘটনায় মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হতেই থাকবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার তাদের গ্রহণও করবে না। অন্যদিকে, পবিত্র কোরান অবমাননাকর ছবি ফেসবুকে কৌশলে ট্যাগ করে দিয়ে ক্ষেপিয়ে তোলা হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকজনকে। যার নেপথ্যে জামায়াত-বিএনপির ইন্ধনের বিষয়টি স্পষ্ট। এ ঘটনা ঘটানোর আগে জামায়াত-বিএনপির কিছুসংখ্যক নেতা বিভিন্ন পয়েন্টে গোপন বৈঠক করার তথ্যও মিলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জামায়াতে আরাকান, হিযবুত তাহ্রীর, আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়ন (এআরআই) ও দেশীয় জামায়াতে ইসলামীসহ উগ্রপন্থী একাধিক জঙ্গী সংগঠন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বর্তমান সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করে বেকায়দায় ফেলার অপতৎপরতার অংশ হিসেবে এ ধরনের জঘন্যতম ঘটনার জন্ম দেয়া হয়েছে। সূত্রমতে, এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের নীলনকশায় ছিল এ ঘটনা দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে রীতিমতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হবে সর্বত্র। যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বানচাল ও নাশকতা সৃষ্টির বিষয়টি এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঘটনার আগে রোহিঙ্গা মৌলভী দ্বারা পরিচালিত কক্সবাজার ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির একাধিক মাদ্রাসা থেকে উস্কানি দিয়ে অসংখ্য উগ্র ছাত্রকে একাধিক ট্রাকযোগে জমায়েত করা হয়েছিল রামু স্টেশন ও এলাকার মিঠাছড়িতে। পাশাপাশি শতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া সৃষ্টির মাধ্যমে ধর্মীয় সেøাগান দিয়ে বিহার, মন্দিরের দিকে এগিয়ে যায় ক্যাডাররা। তারপর একে একে গানপাউডার ও পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় বিহার, মন্দির ও বসতবাড়ি। মুসলিম সম্প্রদায়ের উত্তেজিত লোকজনরা ধারণা করেছিল, ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা ও কোরানের অবমাননার বিরুদ্ধে হয়ত প্রতিবাদ সভা হবে। নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রাখা হবে। এতে শরিক হলে পুণ্যের ভাগি হওয়া যাবে। এ ধারণায় যোগ দেয় সাধারণ একশ্রেণীর মানুষ। কিন্তু প্রতিবাদসভা চলাকালে দেখা গেছে, লিংকরোড ও নাইক্ষ্যংছড়ির উভয় দিক থেকে অসংখ্য মোটরসাইকেল ও ট্রাকযোগে খ- খ- মিছিলসহকারে অচেনা লোকজন এসে সভাস্থলে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। মিছিলসহকারে গিয়ে বড়ুয়াপাড়ায় এবং মন্দিরগুলোর ওপর হামলে পড়ে গানপাউডার ও পেট্রোল ছিটিয়ে দেয়। এ ভয়াবহ তা-ব রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত চলে। আবার দমকল বাহিনীকে বাধা দিতে পথিমধ্যে কিছুসংখ্যক উগ্রবাদী জঙ্গী নেতা রোহিঙ্গা ছাত্রদের নিয়ে অবস্থান নেয়। ঘটনার নীলনকশা তৈরি করে তাদের সহযোগীদের পুরো দায়িত্ব অর্পণ করে কতিপয় জঙ্গী ও জামায়াতের সংশ্লিষ্টরা ঘটনার রাতে এলাকার বাইরে চলে যায়। এর কারণ হচ্ছে- তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর তাদের দাবি হবে তারা ঘটনার সময় এলাকায় ছিলেন না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং আক্রোশমূলক।
ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা
সাম্প্রদায়িক এ হামলার পেছনে শুধু রাজনীতিই নয়, ছিল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টাও। একটি গোষ্ঠী প্রমাণ করতে চেয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকাকালেও সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়। ঘটনার পর একটি দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও তা বলতে শুরু করেছেন। রামুর ১৩টি বিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর চালিয়ে তারা একদিকে যেমন এ সরকারের আমলেও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা দেখাতে চাইল, অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল এ শক্তি নিজেদের ক্ষমতারও জানান দিল। এদিকে রামু বাজারসংলগ্ন শ্রীকুল লালচিং বৌদ্ধ মন্দিরের ভূ-সম্পত্তি দখলের জন্য একটি গ্রুপের দীর্ঘদিনের অপতৎপরতার তথ্যও বেরিয়ে এসেছে। এই মন্দিরের মালিকানার কিছু ভূমি অনৈতিক পন্থায় ক্রয় করার চেষ্টায় দীর্ঘদিন ধরে তৎপর রয়েছেন অভিযুক্ত টিভি চ্যানেল প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয়দানকারী জাফর।
শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর ২০১২, ৪ কার্তিক ১৪১৯
 রামুর ঘটনার মূল উদ্দেশ্য বিশ্বে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা
সম্মিলিত আইনজীবী পরিষদের তদন্ত প্রতিবেদন
স্টাফ রিপোর্টার ॥ সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এম আমীরুল ইসলাম বলেছেন, রামু উখিয়ার আক্রান্ত বৌদ্ধ জনপদগুলোতে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষয়ক্ষতি একধরনের সুনামি সমান ধ্বংস যজ্ঞ সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় প্রশাসন তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঘটনার সময় স্থানীয় প্রশাসন ছিল নির্বিকার নিলিপ্ত ও নেতৃত্বহীন। এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্র । সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা এবং সারাবিশ্বের কাছে ও নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করাই মুখ্য বিষয়। কক্সবাজারের রামু উখিয়া টেকনাফ পটিয়ার সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কে সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করার সময় তিনি একথা বলেন। উল্লেখ্য, ১১ থেকে ১৩ অক্টোবর ১৬ সদস্যের আইনজীবী প্রতিনিধি দল রামুসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন।
ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন,বাঙালী জাতিকে ১৯৭১-এর মতো ঐক্যবদ্ধ একটি অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। দলমত, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সমঅধিকারের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে মুক্তি ও সচেতনতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে সুদৃঢ় করতে সকলকেই সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিবেদন প্রকাশ করার পাশাপাশি আইনজীবীদের পক্ষ থেকে ৭ দফা পরামর্শ পেশ করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, যে ১৬টি বা ১৭টি মামলা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে আসামিদের দ্রুত শনাক্ত করা এবং আসামি ও সাক্ষীদের কাছ থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ও ১৬৪ ধারার জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরী। দ্বিতীয়ত সকল ঘটনাস্থল থেকে অবিলম্বে আলামত জব্দ করা। যেমন, গান পাউডারের নমুনা, টায়ার, মন্দিরের পোড়া কাঠ, সিমেন্টের নষড়পশ যা ঢিল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ও দাহ্য পদার্থ বহনে যেসব গাড়ি ব্যবহার করা হয় এবং বিশেষ করে উদ্ধারকৃত ৭টি গ্রেনেডের ওপর হস্তরেখা, তার পরিচিতি ও শনাক্ত করণ উৎস এবং নাম্বার নিশ্চিতকরন ইত্যাদি। তৃতীয়ত এরূপ মামলার তদন্তে ঈ.ও.উ ও উ.ই.-র সহায়তা নেয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রয়োজনে ঢাকা থেকে দক্ষ অফিসার নিয়োগ চাওয়ার কথাও বলা হয়। তাছাড়া কক্সবাজার বারের নেতৃবৃন্দ প্রশাসনকে আইনী সহায়তা দেবার আশ্বাস দেন। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে কোন উৎসাহ প্রকাশ করেনি। চতুর্থত কক্সবাজার জেলা ভৌগোলিক ও ঝঃৎধঃবমরপ নিরাপত্তা বিষয়ক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে একটা আধুনিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরী প্রয়োজন। প্রয়োজনে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ করার পাশাপাশি একটা চৌকস সীমান্ত বাহিনী গড়ে তোলা যাতে রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন একমত পোষণ করে। পঞ্চমত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিচালনার ক্ষেত্রে ট.ঘ.ঐ.ঈ.জ-এর একক তত্ত্বাবধায়নের পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট ও সক্রিয় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, থাকা খাওয়া চলা ফেরা সব বিষয় নজরদারিতে রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থাপনায় সরকারের দৃঢ় ও অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। বিদেশে দাঙ্গা বিধ্বস্ত অশান্ত অঞ্চলে আমাদের সেনা বাহিনীর শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যে সাফল্যময় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তেমনি একটি চৌকস ইউনিটকে কক্সবাজারে নিয়োগ করে বিষয়টি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। ষষ্ঠত কক্সবাজারজুড়ে বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কার্যকর নজরদারি এবং বিভিন্ন বিষয়ে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে সার্বিক বিষয় নিয়মমাফিক প্রয়োজনীয় আগাম তথ্য সরবরাহ করার দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে হবে ও সর্বশেষ লুট হয়ে যাওয়া বৌদ্ধ মূর্তি ও নিদর্শনগুলো উদ্ধার করার জন্য পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রশাসনের তৎপরতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন অনেকেই।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়া অঞ্চলের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। এটা বাংলাদেশের সভ্যতা সম্প্রীতির তীর্থ ভূমি। ইতিহাসের নানা উত্থান-পতনে, বৌদ্ধ-বাঙালী, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে কখনই এখানে চিড় ধরাতে পারেনি। মন্দিরের পাশেই রয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা। একই পাড়ায় পাশাপাশি বাস করছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান পরিবার। রামুর মূল বৌদ্ধ মন্দিরের পাশেই আছে মুসলিম বসতি। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মুসলমান প্রতিবেশীরা বহু বৌদ্ধ পরিবারকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেন এবং তাদের জীবন রক্ষা করেন। হিন্দু মুসলিম বা বৌদ্ধ-মুসলিম বিদ্বেষ সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত এ জনপদে। সেখানে এমন নারকীয় ঘটনা কি করে ঘটলো এ প্রশ্ন আমাদের মতো কক্সবাজারের সকল মানুষেরও মুখে মুখে।
স্থানীয় সকলের ধারণা ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার-রামু-উখিয়া-পটিয়ায় বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ পল্লীতে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও সন্ত্রাসের যে মর্মান্তিক বর্বরোচিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তা একটি পূর্বপরিকল্পনা ও কুচক্রান্তের অংশ এবং এর শেকড় অনেক গভীরে। দেশ ও দেশের বাইরেও এ শিকড়ের বিস্তৃতি থাকাও বিচিত্র নয়। ঘটনার ধারাবাহিকতা থেকে এটা স্পষ্ট, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী ও মন্দিরগুলো লুট ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে অশান্ত এবং ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি ছিল আক্রমণের মূল লক্ষ্য। ঘটনাটি এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যা বাইরে থেকে মনে হতে পারে যে ঘটনাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্ত উত্তেজিত জনরোষের ফলে। কিন্তু আমাদের দেখা মতে মনে হয়েছে ঘটনার অনেক পূর্বে থেকে প্রস্ততি নেয়া হয়েছিল এমনটিও হতে পারে, যারা এ ধ্বংস সৃষ্টি করেছে তারা মূল ষড়যন্ত্রের দুটি ধারায় কাজ করেছে। একটি দল ছিল লুটেরা বাহিনী যারা গান পাউডার, গ্রেনেড, টায়ার, পেট্রোল ও দাহ্য পদার্থ ও সেই সঙ্গে কংক্রিটের ছোট ছোট ব্লক , গাড়ি পিক আপ নিয়ে লুটের প্রস্তুতি নিয়েছে। অপরদিকে লোক জড়ো করার জন্য একজন বড়ুয়া খুঁজে বের করেছে যার ফেসবুকে অশ্লীল ছবি ঢুকিয়ে তাকে দায়ী করে বৌদ্ধদের টার্গেট করতে পারবে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা ছিল তাদের কাজ। এই দুটি ধারার কাজকে একত্রিত করে এই নৃশংস সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সারারাত এক নারকীয় তা-ব চালানো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। আর এ দলের পেছনে কাজ করেছে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা এবং সারাবিশ্বের কাছে ও কাছের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা। বিশেষ করে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে চিড় ধরানোর কাজটিও একই সঙ্গে সম্পন্ন করা ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য হতে পারে।
উল্লেখ্য, এরূপ একটি মিটিং সংগঠিত হয় মূল ঘটনার একদিন পূর্বে। সেদিন এমন কোন ঘটনা ঘটেনি, যা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে, তাহলে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য আসবে কেন, যেখানে ‘ফেসবুক গল্প’ ছিল পরবর্তী দিনের ঘটনা। যে অমূল্য মূর্তিগুলো লুট হয়েছে সেগুলো লুট করা এবং এই আক্রমণের পেছনে যে সব শক্তি কাজ করেছে তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কি না? আন্তর্জাতিক কালোবাজারে এসব পুরাকীর্তি পাচারের মাধ্যমে লাখ লাখ ডলারে বিক্রি হতে পারে। লুট করা যাদের মূল লক্ষ্য তাদের এ কাজে কেউ নিয়োগ করেছে কি না সে শক্তিটাকেও খুঁজে বের করতে হবে। অথবা যারা লুট করেছে তারা মনে করেন কিনা যে একটি মুসলমান দেশে মূর্তির প্রয়োজন নেই এবং তার বিনিময়ে যদি প্রচুর অর্থ পাওয়া যায়, তাহলে ক্ষতি কি? তাই আমরা মনে করি লুট হয়ে যাওয়া মূর্তিগুলো খুঁজে উদ্ধার করা তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। লুটের মাল ও লুটের হোতাদের পাওয়া গেলে তাদের যারা নিয়োজিত করেছিল এ কাজে তাদের পরিচয়ও পাওয়া যাবে।
আমরা সরেজমিন অনুসন্ধান করে দেখেছি ও জেনেছি যে সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য মিটিং মিছিল, লোক যোগাড় করা এবং রাত ১০ থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত রামু এবং ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও পটিয়া টেকনাফের বিভিন্ন অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। রামুর-কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ মন্দিরসহ নিভৃত পল্লীতে গান পাউডার দিয়ে মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয় । বৌদ্ধ মন্দিরের বহু পুরান অমূল্য স্বর্ণ মূর্তি, আট ধাতু ও কষ্টি পাথরের মূর্তিগুলো লুট করে নেয় । বড় মূর্তি যেগুলো বয়ে নিয়ে যেতে পারেনি তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। টায়ার ও পেট্রোলসহ অন্যান্য দার্হ্য পদার্থ তারা ব্যবহার করে । ফলে দুই হাজার বছরের পুরান অমূল্য পুঁথি সামগ্রী, তাল পাতায় পালি ভাষায় রচিত গান, কবিতা গৌতম বুদ্ধের বাণীসহ অনেক বই পুস্তক পুড়ে গেছে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার উৎস ও এই হামলার উৎস এক কিনা এটাও তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। রামুতে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখতে পাই সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার যার আশপাশে ২৫টা বসতবাড়ি ভস্মীভূত। সাদা চিং বিহার, লাল চিং বিহার, অর্পণা চরণ বিহার, রামু মৈত্রী বিহার, সীমা বিহার, রাইখান বড় কেয়াং পাহাড় ও টিলার ওপরে, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার, সীমা বিহার, ধাতু মন্দির, ধাতু চৈত্র মন্দির, ১০০ ফুট লম্বা বুদ্ধের সিংহশয্যা এই সব মন্দির ও আশপাশের স্থাপনায় একইভাবে এবং একই প্রক্রিয়ায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়। রামুতে এ রকম তেরটি মন্দির আমরা পরিদর্শন করি। মন্দির অধ্যক্ষ পুরোহিতের সঙ্গে এবং স্থানীয় বাসিন্দা দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলি ও স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জানতে পারি একই প্রক্রিয়ায় মন্দির লুট, অগ্নিসংযোগ ও ত্রাস সৃষ্টি করার হৃদয়বিদারক বর্ণনা।
হামলাকারীদের অনেকের পরনে ছিল হাফপ্যান্ট, গায়ে সবুজ জামা, মাথায় ফেটি বাঁধা। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ধারণা এদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের বেশি নয়। মধ্য রাতে খয়রাত পাড়ার রাজ পাল্য বৌদ্ধ মন্দির এরা পুড়িয়ে দেয়। এখানে অনেকের মুখে মুখোশ দেখা যায় বলে জানায়। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনা সম্পর্কে যে তথ্য দেন তাতে ঐ রাতে তারা ঘর থেকে বের হননি এবং ঘটনা থামানো বা প্রতিহত করার কোনও পদক্ষেপের কথা তারা উল্লেখ করেননি। পুলিশ সুপারের ভাষ্য অনুযায়ী রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে তিনি যোগাযোগ রাখছিলেন। সন্ধ্যা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত তিনি মিটিং মিছিলের খবর পাচ্ছিলেন, ওসি পুলিশ সুপারকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু পুলিশ সুপার নিজে বা অন্য কোন এজেন্সি এ ব্যাপারে কোন তৎপরতা গ্রহণ করেছে বলে কোন তথ্য আমরা পায়নি। বরং ভুক্তভোগীরা টেলিফোনে যোগাযোগ করে ফোর্স পাঠানোর তাগিদ ও ১৪৪ ধারা বা কার্ফু জারি করার দাবি জানানো সত্ত্বেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি বলে সকলের অভিযোগ। এমনকি ফায়ার ব্রিগেডকে ফোন করে জানালেও তারা ঐ সময় ঐস্থানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বলেন তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে কোনও খবর পাননি। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বলেন যে, তিনি কক্সবাজার অবস্থানরত বিজিবির কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তাদের নিযুক্ত হতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে । স্থানীয় লোকজন অনেক আইনজীবী, স্থানীয় নেতা ও বিপদগ্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানান। প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা বা কার্ফু জারির জন্য অনুরোধ জানান। প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার, নির্লিপ্ত ও নেতৃত্ববিহীন। দৃশ্যমান অপরাধীদের কেন ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হলো-ফলে তারা জামিনে বেরিয়ে আসছে। অথচ নিরপাধ স্থানীয় প্রতিবেশীদের ধরার ফলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রশাসন কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।
আইনজীবীদের টিমে যে সমস্ত নেতা ছিলেন তারা হলেন, ব্যারিস্টার এম. আমীরুল ইসলাম (আহ্বায়ক) সৈয়দ রেজাউর রহমান- সদস্য, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, সুব্রত চৌধুরী সদস্য সচিব মুনসুরুল হক চৌধুরী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, মোঃ আব্দুল্লাহ আবু, কে, এম সাইফুদ্দিন আহম্মদ, মোঃ নুরুল ইসলাম সুজন, এমপি, মোঃ মাহবুব আলী, রকিবুল হক মিয়া রিপন, মোঃ হেলাল উদ্দিন, সৈয়দ মামুন মাহবুব, মোহাম্মদ আলী, নজিবুর রহমান, শেখ আলী আহাম্মদ খোকন, ও প্রণব সাহা।

শুক্রবার | ১৯ অক্টোবর ২০১২ |
 
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম ব্যুরো
কক্সবাজারে নাশকতার নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত না করেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হলো উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত রিপোর্ট। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত দুই শতাধিক ব্যক্তির নাম-ঠিকানা উল্লেখ করেছে তাদের রিপোর্টে। স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ আছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। তবে নেপথ্যে থেকে কারা এ পরিকল্পিত নাশকতা ঘটিয়েছে, তাদের নাম-ঠিকানা বের করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। সিআইডির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দলও খুঁজে পায়নি ঘটনার নেপথ্য নায়কদের। এমনকি আলামত হিসেবে সংগৃহীত বিস্ফোরক জাতীয় সব পদার্থের নমুনাও এখনও পাঠানো হয়নি সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে। পাওয়া যায়নি ১৫ দিন আগে পাঠানো নমুনার ফলও। 
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা স্বীকার করে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সিরাজুল ইসলাম খান বলেন, 'তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সিলগালা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। এ রিপোর্ট এখন জনসমক্ষে প্রকাশ হবে কি-না, তা সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।' 
অন্যদিকে 
ঘটনাস্থল 
থেকে বিস্ফোরকের আলামত সংগ্রহ করা সিআইডির এএসপি হ্লা সিং প্রু বলেন, 'ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত আমরা তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়ে এসেছি। গডফাদারদের চিহ্নিত করার স্বার্থে প্রয়োজনে এসব আলামত সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব কিংবা ঢাকার ল্যাবে পাঠাতে পারেন তদন্ত কর্মকর্তা। আমি যতটুকু জানি সংগৃহীত সব আলামত এখনও সিআইডির চট্টগ্রাম ল্যাবে পাঠানো হয়নি। দাহ্য জাতীয় কিছু পদার্থের আলামত পাঠানো হলেও সেগুলোর রিপোর্ট এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ঢাকা থেকেও আসেনি গান পাউডার জাতীয় পদার্থের চূড়ান্ত ফল। ফলে নেপথ্য নায়কদেরও চিহ্নিত করার কাজটি সম্পন্ন হয়নি।'
জানা গেছে, উচ্চ পর্যায়ের এ তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে সরাসরি হামলার ঘটনায় জড়িত দুই শতাধিক ব্যক্তির নাম-ঠিকানা উল্লেখ করেছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি ও পুলিশের কাছে থাকা ভিডিও ফুটেজ দেখে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় তদন্ত কমিটি। কোরআন অবমাননার বিষয়টিকে পুঁজি করে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে ঘটনাটিতে ইন্ধন দিয়েছে জামায়াত-শিবিরসহ সমমনা কয়েকটি ইসলামী দলের কর্মী সমর্থকরা। নাশকতা দমাতে বিএনপি দলীয় স্থানীয় এমপি লুৎফুর রহমান কাজল ও আওয়ামী লীগ দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সারওয়ার কাজল চেষ্টা করলেও তাদের উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না। রামু থানার তৎকালীন ওসি নজিবুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবী চন্দের সঙ্গে কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী ও পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল। ঘটনার গুরুত্ব তারা কেউই যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেননি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি। 
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ
রামু, টেকনাফ ও উখিয়াতে সংঘটিত ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা তদন্ত কমিটির কাছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন। পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ঘটনা অবহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত পুলিশ ফোর্স রামুতে পাঠিয়েছেন বলে তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। পাল্টা লিখিত বক্তব্য দিয়ে তার এ দাবি অস্বীকার করেছেন রামুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবী চন্দ ও ওসি নজিবুল ইসলাম। পরে আনুষ্ঠানিকভাবেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলিশ সুপারকে ঘটনার জন্য দায়ী করে বক্তব্য দেন। এখানে তিনি নাশকতা দমাতে পুলিশ সুপার মাত্র ১০ জন অতিরিক্ত পুলিশ রামুতে পাঠিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তদন্ত কমিটির কাছে পুলিশ সুপার ৪০ জন অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনার রাতে কক্সবাজার থেকে রামুতে পাঠিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্যই সমন্বয়হীনতা প্রমাণ করে বলে মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটি। 
হামলাতে ইন্ধন দিয়েছে জনপ্রতিনিধিরা
রামুর পুলিশ প্রশাসন ঘটনার রাতে চৌমুহনী চত্বরে অনুষ্ঠিত সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও অন্যান্য দুর্গম এলাকায় তখন দুষ্কৃতকারীরা সংগঠিত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের পরিকল্পনা ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। ভিডিও ফুটেজে অনেক জনপ্রতিনিধিকে বিক্ষোভ মিছিলের সামনে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। পরে এসব মিছিল থেকেই একটি অংশ ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের কাজে নেতৃত্ব দেয়। জনপ্রতিনিধিরা তখন তাদের নিবৃত্ত করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। ততক্ষণে বাইরে থেকে বিভিন্ন যানবাহনে করে বহিরাগতরা এসে নেতৃত্ব দেয় ভাংচুরে। বিএনপির স্থানীয় সাংসদ লুৎফুর রহমান কাজল ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সারওয়ার কাজল চৌমুহনী চত্বরে বিক্ষোভ দমনে চেষ্টা করেছিলেন। পরে যখন বিক্ষোভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন তারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। দায় এড়াতে বিএনপির সাংসদ চলে যান রামু সদরে। উপজেলা চেয়ারম্যান ১৪৪ ধারা জারি করতে প্রশাসনকে অনুরোধ করলেও সেখানে সমন্বয়হীনতা থাকায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেরি হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে।
আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ছিল আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে
তদন্ত কমিটিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে ঘটনার দিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি কাজ করায় নাশকতা বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাইমুম সরওয়ার কমল সম্পর্কে ভাই হলেও এলাকার আধিপত্য নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে। এ ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যানকে বিপাকে ফেলতে চেয়েছে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তাই বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মানুষজনকে সংগঠিত করে কমলের লোকজন। কাজলের লোকজন সেটি নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। দুই ভাইয়ের এ কোন্দলকে পুঁজি করে নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে জামায়াত-শিবির ও ইসলামী ঐক্যজোটের কিছু নেতাকর্মী। তারা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ব্যবহার করেছে বিএনপিপন্থি স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধিকেও। 
আড়ালে থেকে গেছে বিস্ফোরক সংগ্রহকারী গডফাদাররা
নেপথ্যের গডফাদারদের ধরতে রাসায়নিক বিশেষজ্ঞকে নিয়ে সিআইডির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থলে যায়। পাঁচ সদস্যের এ বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল থেকে গান পাউডার, ককটেল, পেট্রোলসহ বিভিন্ন বিস্ফোরকের আলামত সংগ্রহ করে। পরীক্ষার জন্য এসব আলামত তদন্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে আসে সিআইডির নেতৃত্বাধীন এ দল। সংগৃহীত এসব আলামতের সবকিছু এখনও পরীক্ষার জন্য পাঠাননি তদন্ত কর্মকর্তারা। কিছু দাহ্য পদার্থের আলামত সিআইডির চট্টগ্রাম ল্যাবে পাঠানো হলেও সেগুলোর পরীক্ষা এখনও সম্পন্ন হয়নি। আবার গান পাউডার শনাক্ত করতে সংগৃহীত আলামত আরও ১৫ দিন আগে ঢাকায় পাঠানো হলেও পাওয়া যায়নি সেগুলোর ফলাফল। ফলে পরিকল্পিত এ নাশকতায় আসলে গান পাউডার কিংবা ককটেলের মতো বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছে কি-না, হলে এগুলো কোথা থেকে এসেছে, কারা এনেছে_ গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রশ্ন রয়ে গেছে অজানা। সিআইডির ফরেনসিক দলে থাকা এএসপি হ্লা সিং প্রু বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, 'ঘটনার নেপথ্য নায়কদের ধরতে হলে বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থের ফলাফল পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজটি করবেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তারা প্রয়োজন মনে করলে সিআইডি কেবল কোনো বিষয়ে তাদের সাহায্য করবে।' গডফাদারদের চিহ্নিত করার দায় এভাবে একজন আরেকজনের ওপরে চাপানোয় নেপথ্য নায়করা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির মহাসচিব আদর্শ কুমার বড়ূয়া। 

অহিংস ধর্মে হিংসার আঘাত এবং একটি ধর্মাশ্রয়ী প্রতিবাদ

ক্যাটাগরী: 

অহিংস যাদের পরম ধর্ম সেই বৌদ্ধরা আক্রান্ত হয়ে বাস্তুভিটা বিচ্যুত হলো এবং একজন বৃদ্ধা নিহত হলো নিজের দেশ নিজের মাতৃভূমিতে তাদের দ্ধারা, যাদের পরম ধর্ম শান্তি।এই আক্রমনটা যদি কোন রাজনৈতিক কূটকৌশলও হয়,এবং তাতে যদি মুসলমান,হিন্দু এমনকি যদি বৌদ্ধ ধর্মালম্বীও থাকে নিশ্চিত ভাবে তারা তাদের স্ব স্ব ধর্ম থেকে অবশ্যই বিচ্যুত হয়েছেন।কারন কোন ধর্মই অন্য ধর্মকে আঘাত হানা সমর্থন করে না।
আর যদি মুসলমান হয় তারা মুসলিম সম্প্রদায়কে এবং ইসলামকে অপমান করেছেন কারন ইসলাম এ ধরনের ধংসাত্বক কাজ কোন অবস্হাতেই সমর্থন করে না বরং এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে।
যে ধর্মর মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে যে নামেই ডাকুক সারা বিশ্বের সব ধর্মের ধর্মপ্রান মানুষরা সৃষ্টিকর্তা যে একশ্বর এবং শেষ বিচারের মালিক তা বিশ্বাস করে।
সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছা করলে এক নিমেষে পৃথিবি ধংস করে দিতে পারে। তিনি তার সব সৃষ্টির, এমনকি তাঁর প্রতি অবিশ্বাসীদের প্রতিও তিঁনি দয়াময়, তাদের রুটি রোজগারের ব্যবস্হা তিনিই করেন অথচ তাঁরই সৃষ্টি মানুষ ধর্মের নামে ধংস চালিয়েই যাচ্ছে।নিজের ধর্মের প্রতি অন্যের অশোভন আচরন যদি অপমানকর হয় তাহলে অন্যের ধর্মের প্রতি অশোভন আচরনও তেমনি হওয়ার কথা।
আশরাফুল মখলুকাত বলতে সৃষ্টিকর্তা শুধু মুসলমানের কথা বলেন নি, সারা বিশ্বের সমস্ত মানব সম্প্রদায়ের কথা বলেছেন, বিশ্বের প্রতিটি ধর্মের মানুষের কথা বলেছেন,এমনকি তাঁর প্রতি অবিশ্বাসিদের কথাও বলেছেন।
ধর্মিয় বিশ্বাসের বিচার করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারও নেই।
তাহলে ওরা কারা যারা সারা বিশ্বে ধর্মের নামে ধংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে?ধর্মিয় প্রতিষ্ঠান ধংস করছে?
সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে শান্তির ধর্ম ইসলামকে একটি সন্ত্রাসি ধর্ম হিসাবে পরিচিতি দিতে চাচ্ছে।
যে অদৃশ্য শক্তি একশ ফিট লম্বা বৌদ্ধদের মূর্তিটি রক্ষা করেছেন সেই অদৃশ্য শক্তিই মহাবিশ্ব নিয়ন্ত্রন করেন। তিঁনি সৃষ্টিকর্তা।বিশ্বাসী,অবিশ্বাসী সবাইকে তিনিই রক্ষা করেন।
স্রষ্টার বিচারিক ক্ষমতা কি তার সৃষ্টি নিজের হাতে তুলে নিতে চাচ্ছে ?
তবে কি কিছু মানুষ নিজেদেরকে সৃষ্টিকর্তার চেয়েও ক্ষমতাশালী মনে করে?
আবহমান কাল ধরে যে সামাজিক ও ধর্মিয় সম্প্রীতি এ দেশের অহংকার তাতে কেউ বিষবাষ্প ঢেলে দিতে চাচ্ছে।এখনি এদের রুখতে না পারলে একদিন এই বিষবাষ্প পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিকল করে দিতে পারে।

ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর ২০১২ ব্লগ

সৃষ্টিকর্তা কি ছোটোলোক? (পর্ব-১)

ক্যাটাগরী: 

    সব ধর্মেই বলা হয়ে থাকে সৃষ্টিকর্তা সর্ব শক্তিমান। তিনি কি কোনো জীব? না তিনি কোনো জীব নয়। তিনি কি মানুষ? জীবই যদি না হয়, তাহলে মানুষ তো নয়ই। তিনি কোনো জীব নয়, মানুষ নয়। তাহলে আমরা ‘তাকে’ ‘তিনি’ বলে সম্বোধন করি কেন? আর সৃষ্টিকর্তা শব্দটাই তো ঠিক নেই। কারন কর্তা মানে হচ্ছে ব্যক্তি (মানুষ)। সৃষ্টিকর্তার মানে দাঁড়ায়, কোনো ‌’ব্যক্তি’ যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন।
সৃষ্টিকর্তার পরিবর্তে আমরা বলতে পারি সর্ব শক্তিমান কোনো ‘জিনিস’ বা ‘কিছু’। এবং এখানেই আমাদের থেমে যেতে হবে। ওই ‘জিনিস’ সম্পর্কে আর কিছু বলা যাবে না। কারন সর্ব শক্তিমান কেনো ‘জিনিস’ বা ‘কিছু’ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। মানুষ সর্ব শক্তিমান নয়। আর ওখানেই না থেমে যদি ওই ‌’জিনিস’ সম্পর্কে আর কিছু বলা হয়, সেটা মানবিক পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্রতিষ্ঠিত কোনো ধর্মই এখানে থেমে যায়নি। সর্ব শক্তিমান ‘জিনিস’ বা ‘কিছুকে’ প্রতিটা ধর্মই মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। জিনিসটার সব কর্মকাণ্ডই মানুষের মতো। সর্ব শক্তিমান ওই জিনিসের মানবিক অনুভূতি রয়েছে। যেমন উপাসনা করলে তিনি সন্তুষ্ট হন। সন্তুষ্ট হওয়াটা মানবিক অনুভূতি। যার অতুষ্টি আছে তাঁর মধ্যেই সন্তুষ্টি অনুভূতি রয়েছে। মানুষের অতুষ্টি রয়েছে। কারন মানুষসহ সব জীবকেই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়।
সর্ব শক্তিমান জিনিসের মধ্যেও কি অতুষ্টি রয়েছে? ধর্ম অনুযায়ী ‘জিনিস’টার মধ্যে মানবিক অনুভূতিও রয়েছে। সর্বোপরি প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলো ওই সর্বশক্তিমান জিনিসটাকে পরিপূর্ণ ‌’মানুষ’ বানিয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষটাকে বানানো হয়েছে ছোটলোক মানুষ হিসেবে।
এবার বিষয়টাকে ন্যাংটা করে বলি, সর্ব শক্তিমান ওই ‘জিনিস’টাকে বলা হয় দয়ালু। দয়ালু অনুভূতি কি মানবিক গুণ নয়? ইসলামে যে ৯৯টা গুণের কথা বলা হয়েছে তাঁর প্রতিটা গুণই মানবিক গুণ। জিনিসটা সমগ্র মহাবিশ্ব পরিচালণাও করেন মানুষের মতো। প্রধানমন্ত্রীর যেমন দেশ পরিচালনার জন্য মন্ত্রী এমপি ও আমলা লাগে। তেমনি সর্ব শক্তিমান ওই জিনিসেরও মহাবিশ্ব পরিচালনা করতে আমলা (ফেরেশতা, দেবদেবী) লাগে। ওই ‘জিনিস’টা প্রতিটা সেক্টরে আমলা রেখে দিয়েছে। মেঘবৃষ্টির জন্য মিকাইল। পাপ পূন্য লেখার জন্য কীরামান কাতিবিন। হিন্দু ধর্মে যেমন বিদ্যার দেবী স্বরস্বতী।
সর্ব শক্তিমান জিনিসের আবার আমলা লাগবে কেন বাপু? সর্ব শক্তিমান কোনো জিনিসের তো এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আমলা লাগার কথা নয়। আর আমলা যদি লাগেই তাহলে জিনিসটা সর্ব শক্তিমান হয় কিভাবে? সব প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ভাষ্য অনুযায়ী, সর্বশক্তিমান ‘জিনিস’টা চলে আমলাতান্ত্রিক সিস্টেমে। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে সবগুলো প্রতিষ্ঠিত ধর্মই ‌’জিনিস’টাকে পরিপূর্ণ মানুষ বানিয়েছে। এবং মানুষটা ছোটোলোক।
ছোটলোক কেন?
একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। গল্পটা আমি একজনের কাছ থেকে শুনেছি। সত্যতা কতটুকু জানি না। গল্পটা হলো, আহমদ শরীফ একবার তাঁর এক পরিচিত আস্তিক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন। হঠাৎ এক প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ তাঁর ওই বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, বিভিন্ন সময়ে তোমরা যে এতো ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ মানে যিকর করো, এতে কি আল্লার রাগ হয় না? বন্ধুটি তখন প্রশ্ন করলো, কেন? আল্লাহর রাগ হবে কেন? তখন আহমদ শরীফ বললেন, ‘আমার সামনে কেউ যদি ১০ বার ‘আহমদ শরীফ’ ‘আহমদ শরীফ’ বলতে থাকে, আমি তাকে থাপ্পড় দিয়ে ফেলে দিতাম। এতোবার ডাকাডাকির কি আছে?

আশা করি গল্পটার মধ্য বিষয়টা বেশ খানিকটা ন্যাংটা হয়েছে। তথাপি বিষয়টাকে আমি আর্ও একটু ন্যাংটা করতে চাই। ধরা যাক, কোনো অপরিচিত ব্যক্তি আমার কাছে কিছুই চায় নি। তবু আমি তাকে মজার কোনো জিনিস দিলাম। এবং আমি মনে মনে চাইলাম ওই ব্যক্তি সারা জীবন আমার নাম নিক এবং আমার স্তুতি করে যাক। আমি কি তাহলে ছোটলোক মানসিকতার লোক নই? এবং যে মানুষটাকে আমি জিনিসটা দিয়েছিলাম সে যদি জানতে পারে আমার মানসিকতা এ ধরনের। তাহলে ওই মানুষটার ন্যূনতম ব্যক্তিত্ব থাকলে বলবে, তোর এই জিনিস কি আমি চেয়েছিলাম? নে ধর, ফিরিয়ে দিলাম।
আমরা কি সর্ব শক্তিমান ওই জিনিসের কাছে বলেছি বা চেয়েছি আমাকে জীবন দিয়ে দুনিয়াতে পাঠাতে? অনেক ধর্ম বলতে পারে যে, হ্যা আমরা চেয়েছি, তাই পঠিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্য চাইলেও তো আমাদের মনে নেই। কারোরই যদি মনেই না থাকে তাহলে ওই চাওয়ার কি কোনো দাম আছে? মানলাম এমন কিছু আছে যা আমাদের সৃষ্টি করেছে। তো কি হয়েছে? তার এতো পূজা অর্চনা বা উপাসনা পাওয়ার এতো খায়েশ তো ছোটলোক মানসিকতারই ইঙ্গিত বহন করে। আমরাও সর্ব শক্তিমান জিনিসটাকে বলতে পারি, তোর এই জীবন কি আমরা চেয়েছি? তুই যদি দিয়েই থাকিস তো ভালো মনে দে। এতো পূজা অর্চনা পাওয়ার খায়েশ তোর কেন?
আবার সৃষ্টিকারী ওই জিনিসের সঙ্গে মানুষের সব সম্পর্কই চাওয়াপাওয়া আর ভয় ভীতির সম্পর্ক। আমার এই পোস্টটি যারা পাঠ করছেন তাদের অনেকেই ভয়ে কয়েক বার নাউজুবিল্লাহ পাঠ করেছেন আমি নিশ্চিত। ধর্মে বলা হয়, একবার অমুক দোয়া পাঠ করলে বা অমুক কাজ করলে এতগুণ সওয়াব। বা অমুক কাজ করলে এতো হাজার বছর নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। এসব কি কথা গো বাপু?
সর্ব শক্তিমান জিনিসকে ছোটলোক মানুষ বানিয়েছে মূলত আস্তিকেরা। জিনিসটাকে ছোট করে দেখেছে আস্তিকেরা। যুগ যুগ ধরে বহু অশান্তি, বহু যুদ্ধের মূলে রয়েছে ধর্ম। সেটা ইতিহাস বলে। নাস্তিকেরা আর যাই হোক সর্ব শক্তিমান জিনিসটাকে অন্তত ছোটোলোক মানুষ বানায়নি।
‘মা’ উপন্যাসে ম্যক্সিম গোর্কি একটা কথা লিখেছিলেন, সৃষ্টিকর্তাকে নতুন করে সৃষ্টি করতে হবে যে সৃষ্টিকর্তা হবে মানুষের বন্ধু।
আমার মামার এক নাস্তিক বন্ধু ছিলেন, নাম তাঁর সেলিম। একদিন মামার বাড়িতে খেতে বসেছি, এমন সময় তিনি হাজির হলেন। তিনিও খেতে বসে গেলেন। যথারীতি ধর্ম প্রসঙ্গ আসলো। তিনি ধর্ম সম্পর্কে কিছু কটু বাক্য বর্ষণ করলেন। এমন সময় আমার ধামিক মামী হায় হায় করা শুরু করলেন। মামির নাম আসমানী।
এক পর্যায়ে সেলিম মামা বললেন, শোন আসমানী বেগম যদি বেহেশতো-দোযথ থেকেই থাকে, তাহলে বলতো তুই আগে বেহেশতে যাবি নাকি আমি যাব? মামি চুপ।
সেলিম মামা বললেন, হাশরের ময়দানে আল্লাহ তোকে বলবে, আসমানী বেগম.., জন্মের পর থেকে তোর পরিবার-সমাজ বলেছে, ‘আমি আছি। আমি দয়ালু। তাই তুই আমাকে সেভাবেই মেনেছিস, আমাকে ভালো ভেবেছিস।’ কিন্তু তোর পরিবার এবং তোর সমাজ যদি বলতো আমি শয়তান। তাহলে তুই তো আমাকে শয়তানই ভাবতিস। তোর তো নিজের কোনো আক্কেলবুদ্ধিই হয়নি। আমি সমগ্র মানবজাতিকে প্রথমে পড়াশোনা করতে বলেছি। জ্ঞানার্জনের কথা বলেছি। তুই তো আমার প্রথম নির্দেশই পালন করিস নাই। তুই তো আমাকে বিচার করার ক্ষমতাই অর্জন করিস নাই ।
কিন্তু এই সেলিম ছেলেটি পড়াশোনা করেছে। জ্ঞানার্জন করেছে। নিজের বিবেককে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছে। পরে, ওর মনে হয়েছে, আমি নেই। তাতে কি হইছে? আর যাইহোক কারও ক্ষতি করে নাই। গাধা আস্তিকের চেয়ে বিবেকবান নাস্তিক আমার কাছে শ্রেষ্ঠ। কাজ্যেই সেলিম তুমি যাও, বেহেশতে গিয়ে ফূর্তিফার্তা শুরু করো। এদিকে দেখি আসমানীর মতো ছাগলদের কি ব্যবস্থা করা যায়!!
সর্ব শক্তিমানের ক্ষেত্রে ‘জিনিস’ বা ‘কিছু’ শব্দটাও আসলে প্রযোজ্য নয়। কারন ‘জিনিস বা ‘কিছু’ বলতে বললে তাঁর আকার-আকৃতি বোঝায়। কিন্তু সৃষ্টিকারী ওই জিনিসের তো আকার-আকৃতি নেই। তাহলে কি বলা যায়? স্রষ্টা? না স্রষ্টা বললেও সক্রিয় কোনো কিছুর অস্তিত্ব বোঝা যায়। তাহলে? সর্বশক্তিমান থেকে আমরা ওই জিনিসটাকে শুধু ‘শক্তি’ বলতে পারি। শক্তির কোনো আকার-আকৃতি নেই। এবং শক্তির নিত্যতা বিধি অনুযায়ীও শক্তি সর্ব শক্তিমান। যার কোনো ধ্বংস নেই। যার কোনো স্রষ্টা নেই। এবং আমার এখনকার ধারণা অনুযায়ী জগতে সর্ব শক্তিমান ওই জিনিসটা হলো শক্তি। যা সব পদার্থের মধ্যে বিদ্যমান। সব কিছুর মধ্যেই শক্তি বিরাজমান। শক্তিকে পূজা করার কিছু নেই।
মানুষই সর্ব শক্তিমান তথা শক্তির স্বরূপ দিয়েছে মানবিকভাবে। ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার মানবিক অনুভূতি ও সত্ত্বা রয়েছে, কিন্তু দুনিয়ার কোনো অমানবিক পরিস্থিতিতে তার কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। অনেক শিশু পাপ করার আগে দুনিয়াতেই জন্মে খোঁড়া, অন্ধ ও বিকলাঙ্গ হয়ে। ধর্মের নামে সংঘর্ষে বিপুল মানুষ নিহত হয়। কোথায় থাকে তখন ঈশ্বরের মানবিক অনুভূতি ?
চলবে…..।

বিশেষ দ্রব্য: পোস্টটিতে সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্ম নিয়েও আলোচনা করা হয়নি। আলোচনা করা হয়েছে সৃষ্টিকর্তার মানসিক সত্ত্বা নিয়ে। কাজেই কোনো ধর্মই এখানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। কাজেই যেচে এসে ব্যক্তিগত আক্রমণ কাম্য নয়। আর লেখাটায় কোনো সিদ্ধান্ত নেই।
একই সঙ্গে যারা আগে পড়েননি তাদের আমার আর একটি পোস্ট পড়ার আহবান জানাই -
 

Dhaka Report
Friday, Oct 19th, 2012
ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম,সব কো সুমতি দে ভগবান 
ফ রি দু জ্জা মা ন 
রামু-উখিয়া-টেকনাফ-পটিয়া ধ্বংসযজ্ঞের বিচার চেয়ে বাঙালি আজ রাস্তায় রাস্তায় মানববন্ধন করছে। তাঁরা বুকে ধারণ করছেন-"আমরা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যতসত্য ;তার চেয়ে অধিক সত্য আমরা বাঙালি। বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান আমরা সবাই বাঙালি। সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই। হিন্দু না ওরা মুসলিম এটা জিজ্ঞাসি কোন জন, কান্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।” হাজার বছর ধরে এ ভূখন্ডে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বসবাস করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একটি অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন স্বার্বভৌম ভাষারাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। মানবতা ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী এ ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ জানানোর জন্য আজ পথে প্রান্তরে শোভাযাত্রা। যে কোন উপাষণালয়ের উপর আঘাত বাঙালি জাতির উপরই আঘাত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি অটুট রাখতেই আমাদেরকে এ আঘাতকে প্রতিহত করতে হবে। বিপন্ন মানবতার ক্রন্দনে বিশ্ববিবেকের কাছে আমাদের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। নিকট অতীতে আমরা আফগানিস্তানে তালেবান কর্তৃক বুদ্ধ বিগ্রহ ধ্বংসের দৃশ্য দেখে হতবাক হয়েছি। এমনটা বাংলাদেশে আমরা হতে দেব না। জঙ্গি দানব রাষ্ট্রেব বিরুদ্ধে আমাদের এ সংগ্রামে পরাজিত হওয়া মানে প্রগতিশীলতার যবনিকাপাত। আমাদের পিট আজ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ দাঁত ভাঙার এখনই সময়। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক এমন দীক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার মন্ত্র বড় বেশী প্রয়োজন আজ। কবির কথাই বলতে হয়-দিকে দিকে মানবাত্মার ক্রন্দন। রূহের ঝরকায় আর্ত্মনাদ। ক্ষমতা ভবনের প্রহরীরা তন্দ্রাচ্ছন্ন যেন। মানব সম্পর্কের বুনটে ফাটল। ধর্মের বেসাতি বদগুণ মানবতা করিতেছে খুন। উড়ে যায়- প্রেম, সংহতি আত্মীয়তা – আস্থার হীরামন পাখি কথকতা। প্রাণ ভোমরার দেহে কতো ক্ষত এঁকে চলে পাপ।ধ্বংস্তুপের নিচে পোড়া বুদ্ধের বিগ্রহ যেন পুড়ে যায় শান্তির রোম। কালের নিরোরা লোফে ধর্মান্ধের ওম। গান্ধীর সুরে শুধু সেই পরম সত্য চেতনা- ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম/ সব কো সুমতি দে ভগবান।

No comments:

Post a Comment