Friday, March 30, 2012

বুদ্ধের শান্তির বাণী উপলব্ধি করতে হবে


     হিংসা নয় মৈত্রী, সংঘাত নয় শান্তি-এটাই ছিল গৌতম বুদ্ধের মূল বাণী। এই বাণী আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। উপমহাদেশের প্রাচীন সম্প্রদায় হচ্ছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়। আর সেই ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহার। এটি দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আজ আমি এখানে আসতে পেরে খুব খুশি।
    গতকাল সকালে নগরীর বৌদ্ধবিহারের পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।   
      তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীতে রূপান্তরে আমরা প্রথম থেকেই কাজ করে আসছি। ইতোমধ্যে বন্দরের অনেক উন্নতি করেছি। এ ধারা অব্যাহত রেখে চট্টগ্রামের আরো উন্নয়ন করতে চাই।
     বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির উদ্যোগে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ গুরু সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাস্থবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া, বৌদ্ধ সমিতির চেয়ারম্যান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া, মহাসচিব আর্দশ কুমার বড়ুয়া ও প্রধান সমন্বয়কারী বিপ্লব বড়ুয়া বক্তব্য রাখেন।
      প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহারে মহামান্য বুদ্ধের কেশধাতু সংরক্ষিত আছে। এই বৌদ্ধ বিহারের ঐতিহ্য রক্ষায় এর পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করা হলো। শুধু এখানে নয়, আমরা লালমাই পাহাড়, মহাস্থানগড়-এসব  ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি।
     তিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতি সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে বলেন, গতবছর ঢাকায় ৭৩৩টি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দিয়েছি। বৌদ্ধবিহারের জন্য দুই বিঘা জমি আমরা বিনামূল্যে দিয়েছি। এই সরকারই প্রথম বৌদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে এবং তাতে এক কোটি টাকা অনুদান দেয়।
      শেখ হাসিনা বলেন, এ দেশের স্বাধীনতা আমরা সকলে মিলে অর্জন করেছি। দেশে সব ধর্মের সমান অধিকার থাকবে। সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একসাথে দেশের উন্নয়নে কাজ করব। এটাই হচ্ছে বাঙালির বৈশিষ্ট্য এবং এটাই তাদের ঐতিহ্য।
     চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারকে জাতীয় বিহার ঘোষণা প্রসঙ্গে বৌদ্ধ সমিতির চেয়ারম্যান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া বলেন, আমাদের অনেক দিনের চাওয়া পূর্ণ হল আজ। ১২৪ বছর পুরনো এই বিহার ঐতিহাসিক ও প্রত্বতাত্তিকভাবে স্বীকৃত। তাই আমরা একে জাতীয় বিহার হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী তা বিবেচনায় নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহারে প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস

বৌদ্ধ-শিব নৈবেদ্যপাত্র
বৌদ্ধ-শিব নৈবেদ্য পাএ 

হাজার বছরের নয়, আড়াই হাজার বছরেরও প্রাচীন আমাদের সংস্কৃতি। রাজধানী ঢাকার অনতিদূর নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরে মিলেছে এমন সব নিদর্শন, যার ভিত্তিতে লিখতে হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। বিস্তারিত জানাচ্ছেন কাজল রশীদ



বৌদ্ধ-শিব নৈবেদ্য পাএ 

মানুষ একদা পাহাড়ের গুহা ও গাছের কোটরে বাস করত, যাকে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ। মানুষের প্রথম স্থায়ী বসতি ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে। ভারতের মেহেরগড়ে মিলেছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম কৃষিনির্ভর স্থায়ী বসতির নিদর্শন। উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া গেছে মাটিতে গর্ত করে বসবাসের উপযোগী ঘরের চিহ্ন গর্ত-বসতি। এখানকার দুর্গ নগরের অভ্যন্তরে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫ শতকের প্রাচীন একটি ঘরের ধসে পড়া মাটির দেয়ালের চিহ্নও পাওয়া গিয়েছে । একমাত্র উয়ারী-বটেশ্বর ছাড়া বাংলাদেশে এ ধরনের মাটির প্রাচীন স্থাপত্যের অবশেষ অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। শুধু গর্ত-বসতি নয়, উয়ারী-বটেশ্বরে মিলেছে এমন সব নিদর্শন, যা দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে, আমাদের সংস্কৃতি আড়াই হাজার বছরের পুরনো। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও এমনটিই বলেছেন: ‘পণ্ডিতেরা যখন আমাদের সংস্কৃতিকে হাজার বছরের বন্ধনীতে বেঁধে দেন, তখন অজান্তে আমার মনে এক ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস পড়ে। আজ উয়ারী-বটেশ্বর উৎখনন কাজের ফলে আমাদের সংস্কৃতি আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন হয়ে গেল।’
উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষকৃত উল্লেখযোগ্য নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে: স্বল্প- মূল্যবান পাথরের পুঁতি, নবযুক্ত মৃৎপাত্র, রাস্তা, ইটের পূর্ণ কাঠামো, বাটখারা, মৃৎপাত্র, মুদ্রা, গর্ত-নিবাস প্রভৃতি।
এসব নিদর্শনের ভিত্তিতে লেখা হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। সূচনা করেছিলেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ পাঠান। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে উয়ারী গ্রামে শ্রমিকেরা মাটি খননকালে একটি পাত্রে কয়েকটি মুদ্রা পান, যা ছিল বঙ্গ ভারতের প্রাচীনতম রৌপ্যমুদ্রা। তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে ‘প্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তি’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যায় ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এভাবেই তিনি প্রাচীনতম নিদর্শনাদি সংগ্রহ ও লেখালেখির মাধ্যমে উয়ারী-বটেশ্বরকে প্রথম সুধী সমাজের নজরে আনেন। পরে তাঁর ছেলে হাবিবুল্লা পাঠান স্থানটির গুরুত্ব তুলে ধরে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন।
উয়ারী-বটেশ্বরের সভ্যতা ও প্রত্নবস্তু নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সোচ্চার থাকলেও উৎখনন হচ্ছিল না। অবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান-এর নেতৃত্বে ২০০০ সালে শুরু হয় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন। তাঁদের উৎখননে উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত হয়েছে এমন সব নিদর্শন, যা জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস।
এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গ-নগর, বন্দর, রাস্তা, পার্শ্ব-রাস্তা, পোড়ামাটির ফলক, স্বল্প-মূল্যবান পাথর ও কাচের পুঁতি, মুদ্রাভান্ডারসহ উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা ও আরো অনেককিছু । নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত ল্যাবরেটরিতে কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হয়। ওই পরীক্ষায় এখানকার দুর্গ-নগর বসতিকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।
উয়ারী গ্রামে ৬০০ মিটার দীর্ঘ বাহুবিশিষ্ট বর্গাকৃতি দুর্গ-প্রাচীর ও পরিখা রয়েছে। ৫.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট আরেকটি বহির্দেশীয় দুর্গ-প্রাচীর ও পরিখা সোনারুতলা গ্রাম থেকে শুরু করে বটেশ্বর, হানিয়াবাইদ, রাজারবাগ ও আমলার গ্রামের ওপর দিয়ে আড়িয়াল খা নদের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটিকে স্থানীয় লোকজন অসম রাজার গড় বলে থাকেন। এরূপ দুটো প্রতিরক্ষাপ্রাচীর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বা প্রশাসনিক কেন্দ্রের নির্দেশক, যা প্রাচীন নগরায়ণেরও অন্যতম শর্ত।
উয়ারী গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৬০মিটার দীর্ঘ, ৬ মিটার প্রশস্ত একটি প্রাচীন পাকা রাস্তা, যা নির্মাণে ব্যবহূত হয়েছে ইটের টুকরা, চুন, উত্তর ভারতীয় কৃষ্ণমসৃণ মৃৎপাত্রের টুকরা, তার সঙ্গে রয়েছে ল্যাটারাইট মাটির লৌহযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরা। এ সম্পর্কে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অভিমত, এত দীর্ঘ ও চওড়া রাস্তা এর আগে পুরো গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ সভ্যতার কোথাও আবিষ্কৃতি হয়নি। গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ বলতে সিন্ধু সভ্যতার পরের নগরায়ণের সময়কে বোঝায়। ফলে যেটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তা শুধু বাংলাদেশে নয়, সিন্ধু সভ্যতার পর ভারতবর্ষের পুরোনো রাস্তার একটি।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খা নদের মিলনস্থলের কাছে কয়রা নামের একটি নদীখাদ রয়েছে, যার দক্ষিণ তীরে গৈরিক মাটির উঁচু ভূখণ্ডে উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে স্থানটিকে আদি-ঐতিহাসিক কালপর্বের বহির্বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে অনুমিত হয়। টলেমির বিবরণ থেকে দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অনুমান, আদি-ঐতিহাসিক যুগে উয়ারী-বটেশ্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণের সওদাগরি আড়ত হিসেবে কাজ করত। তাঁর এই ধারণা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন সুফি মোস্তাফিজুর রহমান নতুন নতুন আবিষ্কারের ভিত্তিতে ।
উয়ারী-বটেশ্বরকে গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমির সৌনাগড়া বলে নির্দেশ করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী। 
উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত এক বর্ণিল টানা কাচের পুঁতি ও স্যান্ডউইচ কাচের পুঁতি থেকে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (থাইল্যান্ড) ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের (রোমান সাম্রাজ্য) বহিঃবাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান উয়ারী-বটেশ্বরকে টলেমির উল্লিখিত সৌনাগড়া বলে উল্লেখ করেছেন।
একদা হানিফ পাঠান যে কাজ শুরু করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতায় এখন প্রমাণিত যে উয়ারী-বটেশ্বরে আড়াই হাজার বছর আগে মানুষ নগর নির্মাণ করেছিল। সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর দলের উৎখনেন প্রাপ্ত নিদর্শনাদি প্রমাণ করেছে আড়াই হাজার বছর আগে উপমহাদেশে যে ষোড়শ মহাজনপদ ছিল, তারই একটি হচ্ছে উয়ারী-বটেশ্বর।

অসাধারণ ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন এই প্রত্নস্থান ও তার প্রত্নবস্তু নিয়ে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও মুহম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান রচনা করছেন উয়ারী-বটেশ্বর শেকরের সন্ধানে নামের বই, যা প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। 
বিচারপতি হাবিবুর রহমান লিখিত মুখবন্ধ এক, ক্যেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী লিখিত মুখবন্ধ দুই, প্রসঙ্গ কথাসহ বইটিতে রয়েছে মোট ২৬টি অধ্যায়। সংযোজিত হয়েছে নির্ঘণ্ট ও রঙিন আলোকচিত্র। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, বিশ্লেষণ, ঐতিহাসিক কাল-সময়-ঘটনাপ্রবাহ নিরূপণ, যুক্তি, মূল্যায়ন উপস্থাপিত হয়েছে এই বইয়ে। গ্রন্থকারদ্বয়ের শ্রমসাধ্য, গবেষণালব্ধ ওই সৃষ্টি উয়ারী-বটেশ্বরকে জানার সুযোগ তৈরি করেছে, যার মধ্যে দিয়ে যে কেউ জানতে পারবে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। যে ইতিহাসের অমর সাক্ষী উয়ারী-বটেশ্বর।
ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খা নদের তীরে অবস্থিত এই স্থান আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এক দুর্গ-নগর। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এটিকে মনে করা হচ্ছে একটি প্রাচীন নদীবন্দর। স্বল্প-মূল্যবান পাথরের পুঁতি ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হওয়ায় মনে করা হচ্ছে, এটি একটি বাণিজ্যনগর। স্থানটি বন্যামুক্ত হওয়ায় এখানে অনেক আগে বসতি স্থাপন মানুষের উন্নত পরিকল্পনা ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিচায়ক। সব মিলিয়ে উয়ারী-বটেশ্বর আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে আমাদের শেকড়ের প্রাচীন সময়কালকে, যা সাক্ষী দিচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি হাজার বছরের নয়, আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্যস্নাত। বাংলাদেশের নতুন এক ইতিহাস এ উয়ারী-বটেশ্বর, যার প্রত্নসম্পদ এখনো আবিষ্কার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তারপরও প্রাপ্ত নিদর্শনে নিশ্চিত হওয়া গেছে আমাদের সংস্কৃতির শেকড় ও তার সময়কাল সম্পর্কে।
খবর প্রথম আলো।

Tuesday, March 27, 2012

যিশুর জন্ম সমাচারঃ পর্ব ২

যিশুর জন্ম সমাচারঃ পর্ব ১
আগের পর্বে আমরা জেনেছি প্রায় সব সুসমাচার রচয়িতারা যিশুকে ঈশ্বরপুত্র হিসাবে দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করে গেছেন এবং একইসাথে যিশু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম গ্রহণ করে্ন বলে মত দেন। কেবল ম্যাথিও এবং লুক ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রমী। ঈশ্বর পুত্র বিশ্বাসের সাথে তাঁদের বাড়তি আস্থা ছিল virgin birth এ। বাইবেল গবেষকরা তাঁদের ব্যতিক্রমী এই বিশ্বাসের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওল্ড টেষ্টামেন্টে ইহুদি জাতির ত্রাণ কর্তারূপে এক ভাবি নবী আগমনের ভবিষ্যত বাণীর একটি শব্দের অর্থগত ভুল বুঝার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। তাঁদের এই ভুলের প্রতিফলন ঘটেছিল অন্ধ অনুসারীদের মনে virgin birth এবং ঈশ্বরপুত্র উভয় যুগপৎ ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে। সমগ্র ওল্ড টেষ্টামেন্ট জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ৬০টি ভবিষ্যৎ বাণী এবং ৩০০ টির অধিক উদ্ধৃতি যাতে স্পষ্ট ঘোষিত হয়েছে ইহুদিদের ভাবি নবী মেসাইয়্যা (Messiah) আগমনের প্রতিধ্বনি। প্রায় ৭০০ বছরের অধিককাল ধরে এই মহাপুরুষের আগমনের প্রতিক্ষায় কিছু ধর্মবাদীর মনে তৎকালীন সমাজে চলে আসা প্রচলিত নানা বিশ্বাস, সংষ্কার, মিথ, কল্পকাহিনি, সমাজ অনুশাসনের নিয়ম কানুন, ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ শয়তানের দৌরাত্ম, ইত্যাদি পুঞ্জিভুত ধারনা ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে তৈরী হয়ে যায় একটি চরম বিশ্বাসের, সেই বিশ্বাস ফুলে ফেঁপে টুইটুম্বুর হয়ে এক সময় বিস্ফোরণের ফলে বিশ্বাসী ধর্মাকাশে উৎপত্তি হয়ে যায় মেসাইয়্যার প্রতিকৃতি যিশু নামের এক বিশাল ধর্ম নক্ষত্রের, তাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে উপগ্রহ সদৃশ এই সব সুসমাচার রচয়িতারা। নানা কল্পনার উপকরণে তৈরী হয়ে যায় একটি শক্তিশালী ধর্ম গ্যালাক্সি। যার অভিকর্ষ প্রভাবে গ্রাস করেছিল বিজ্ঞানের রাজ্যে পথ চলা গ্যালেলিও, ব্রুন সহ অসংখ্য মনীষীর দূর্লভ জীবণ। উল্কাপাত ঘটিয়ে ধ্বংস করতে চেয়েছিল বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার পথ।
যার ভবিষ্যৎ বাণীটিকে ঘিরে এত উন্মাদনা, নতুন বিশ্বাসে আসক্তি, আরো একটি ধর্মের বিকাশ, এত জল্পনা কল্পনা, হাজারো আলোচনা সমালোচনা, বিতর্কের ঝড়ো হাওয়া আজো বয়ে চলেছে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে সে রহস্যময় ভবিষ্যৎ বক্তাকে একটু জেনে নিই।

খ্রীষ্ট পূর্ব ৮ম শতাব্দী্র শেষ দিকে ইস্রাইলের উত্তর দিকে অবস্থিত জুডা(Judah) রাজ্যে ইসাইয়্যা(Isaiah) নামের একজন ধর্মশাস্ত্রবিদ ও উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্গের আস্থাভাজন গোছের ব্যক্তির কথা জানা যায়। যিনি তৎকালীন ইহুদিজাতি গোষ্ঠি অধ্যুষিত ইস্রাইল অ্যাসেরিয়্যান (Assyrian) জাতি (ব্যবেলিয়ান বর্তমান ইরাকের অধিবাসী) কর্তৃক আক্রমণের ফলে উদ্ভুত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় হতোদ্যম ও পর্যুদস্ত ইহুদি জাতির চরম দূর্দশার দিনে ঈশ্বরের উপর অঘাধ আস্থা এনে উদ্দীপনা মূলক একটি ভবিষ্যৎ বাণী ঘোষণা করে হঠাৎ করেই পাদপ্রদীপের আলোয় এসে পড়েন। এই ভবিষ্যৎ বাণী তাঁকে পরবর্তীতে ইহুদি ও খ্রীষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ নবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। এই নবীর নবিত্বের জীবনী নিয়ে বিস্তারিত তেমন কোন তথ্য যদিও পাওয়া যায় না তবে এতটুকুই জানা যায় তাঁর পিতার নাম ছিল আমোজ(Amoz)। ব্যক্তি গত জীবনে তিনি ছিলেন শিক্ষিত, আশাবাদী, দেশপ্রেমী, এবং দুই সন্তানের জনক। ৬৮১-৭০১ সালে তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীকে ভিত্তি করে একটি গ্রন্থ রচিত হয় তাঁর নামানুসারে গ্রন্থটিকে বলা হয় “The book of Isaiah” । গ্রন্থটি ৬৬টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। ১-৩৯তম পরিচ্ছেদ পর্যন্ত তাঁর নামের মহিমা ঘটা করে জানান দিয়ে গেলেও ৩৯তম পরিচ্ছেদ শেষে তাঁর নাম হঠাৎ করেই যেন উদাও হয়ে যায়। এতে বিশেষজ্ঞরা বিরাট খটকার মধ্যে পড়ে যান। ফলে নানা বিচার বিশ্লেষণের দোলাচালে গ্রন্থটিকে তাঁরা তিন ভাগে বিভক্ত করে নেন।
১ম ভাগঃ ১-৩৯তম পরিচ্ছেদ গুলোকে নাম দেন প্রথম ইসাইয়্যা, Proto-Isaiah বা মূল Isaiah।পরিচ্ছেদে গুলি জেরুসালেমে আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৭৪০-৬৮৭ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিল তাতে কারো দ্বিমত নেই।
২য় ভাগঃ ৪০-৫৫তম পরিচ্ছেদ গুলোকে নাম দেন দ্বিতীয় ইসাইয়্যা বা Deutero-Isaiah: এই পরিচ্ছেদ গুলো বেনামী লেখকদের কাজ বলে সাব্যস্ত করেন। যারা ব্যাবিলনের শাসনামলের প্রায় শেষ দিকে বন্দিদশায় থেকে পরিচ্ছেদ গুলো রচনা করেন। আনুমানিক রচনা কাল ধরা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৭-৫৩৮ সাল।
৩য় ভাগঃ ৫৬-৬৬ পরিচ্ছেদ গুলোকে নাম দেন তৃতীয় ইসাইয়্যা বা Trito-Isaiah এগুলো ব্যাবিলন শাসন মুক্ত হওয়া বেনামী ইসাইয়্যা শিষ্যদের কাজ হিসাবে বিবেচিত। যারা ইসাইয়্যাকে নবী মেনে তাঁর অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সামনের দিকে। যাদের স্বপ্ন ছিল একটি নতুন পৃথিবী ও নতুন স্বর্গ গড়া। কিছু কিছু গবেষকদের মতে ৫৫-৬৬তম পরিচ্ছেদ Deutero-Isaiah দ্বারা ব্যাবিলনের পতন পর লিখিত হয়েছিল।
এই The book of Isaiah গ্রন্থেই খৃষ্টের জন্মের প্রায় ৭০০ বছর আগে হিব্রু ভাষায় ভবিষ্যৎ বাণীটি ছিল এইরূপ-
“ঈশ্বর নিজেই আপনাকে একটি লক্ষণ দিয়ে দেবেন। দেখবেন, এক যুবতি মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিবে এবং তাকে ডাকা হবে ইমানিউয়েল নামে”।
এই ছিল ইহুদি জাতির ত্রাণকর্তা “মেসাইয়্যা” আগমনের প্রকৃত ভবিষ্যৎ বাণী। কিন্তু নিয়তির লুকোচুরি খেলায় ইহুদি জাতির রক্ষাকর্তা ভাবি নবী “মেসাইয়্যা” নিজেই অপহৃত হয়ে যান। পরিণত হন যিশুতে।
ম্যাথিও এবং লুক এই “যুবতি মেয়ে”কে “কুমারী মেয়ে” বলে স্থির করায় উপরোক্ত ভবিষ্যৎ বানীটি হয়ে যায়-
“ঈশ্বর নিজেই আপনাকে একটি লক্ষণ দিয়ে দিবেন। দেখবেন, এক কুমারী মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিবে এবং তাকে ডাকা হবে ইমানিউয়েল নামে”।
Isaiah 7:14
Therefore the Lord himself will give you a sign. Behold, the virgin shall conceive and bear a son, and shall call his name Immanuel.
এই Immanuel কথাটার সামগ্রিক অর্থ “God with us ” অর্থাৎ ঈশ্বর আমাদের সাথে আছেন। অধিকাংশ উদার ধর্মতত্ত্ববিদ এবং বাইবেল বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন ম্যাথিও এবং লুকি virgin ধারনার বিশ্বাসটির প্রতি আস্থা এনেছেন হিব্রু “আলমাহ”(almah) শব্দটির অর্থগত ভুল বুঝার কারণে। হিব্রু ভাষায় যা আসলে কোন “যুবতি মেয়ে” বুঝায়। এই “আলমাহ” শব্দটিকে ম্যাথিও এবং লুক হিব্রু থেকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে “যুবতি মেয়ে”র স্থলে অনুবাদজনিত ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারনে কল্পনা করে নেন “পারথিনোস” (parthenos) অর্থাৎ “কুমারী মেয়ে” (এখানে কুমারী মেয়ে বলতে আপনাকে বুঝতে হবে অক্ষত যোনী হিসাবে)। যা পরবর্তীতে virgin Birth ধারনা প্রতিষ্ঠার পেছনে অনবদ্য শক্তি হিসাবে কাজ করে বলে বিশ্বাস করেন নাস্তিক, সন্দেহবাদী এবং ধর্ম নিরপেক্ষবাদীরা। এই “almah” শব্দটি হিব্রু শাস্ত্রে “যুবতি মেয়ে” রূপে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৯ বার উল্লেখ আছে তবে “যুবতি মেয়ে”টি কুমারী ছিল কি ছিল না তা নিয়ে বির্তক অবশ্য কোথাও পাওয়া যায় না। হিব্রু ভাষারীতি অনুসারে কুমারী বুঝাতে ব্যবহৃত হয় “বিতুলাহ”(betulah) শব্দটি।
সেই প্রাচীণ মিসর, গ্রীক, রোম ও তার আশেপাশের প্যাগান সংষ্কৃতিগুলোতে পূজিত হওয়া প্রচুর দেব দেবীর উপস্থিতি লক্ষ্যনীয় বিশ্বাস করা হত তাঁদের জন্ম হয়েছিল কুমারী মায়ের গর্ভে। প্রাচীণ প্যাগান লোক কাহিনিগুলো ভরপুর ছিল অসংখ্য কুমারী মায়ের গল্পে। কয়েকটি উদাহরণ দেখি- গ্রীক দেবতা লিডা(Leda) কুমারী মায়ের গর্ভে জন্ম, মিসরীয় দেবতা “রা”(Ra) বা “সূর্য” কুমারী মায়ের গর্ভে জন্ম, রোমান দেবতা রোমুলুসের(Romulus) জন্ম কুমারী মায়ের গর্ভে, এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে কুমারী মায়ের বিশ্বাস প্রসঙ্গে। সে যুগের সমাজে নানা অলৌকিক বিশ্বাস ঘুরাঘুরি করত মুখে মুখে, চলে আসত তা বংশ পরম্পরায়। পূজিত সব দেবতাই কল্পিত হত বিপুল অলৌকিক শক্তির আধার রূপে। বলা যেতে পারে অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিল অলৌকিক শক্তিহীন দেবতা পূজার অযোগ্য। তাই বড় বড় দেব-দেবীর জন্ম প্রসঙ্গে আমরা একথা সহজেই বলতে পারি দেবতাদের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখতে যৌন নয় বরং অযৌন ক্রিয়ায় জন্মের প্রতি সে সমাজের সাধারণ লোকজনের বিশ্বাস, ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল অঘাধ। কোন এক সময় দেবতাদের প্রতি এই অলৌকিক ক্ষমতা বিশ্বাসের দীর্ঘ রেওয়াজ শুধু দেবতাদের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ রইলনা সে বিশ্বাস ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছিল নবী বলে কথিত কিছু লোকজনের উপর। আমাদের দেশে সাধু, সন্ন্যাসী, পীর, দরবেশ সম্পর্কে এই বিশ্বাস এখনো বর্তমান। আর সেই একি বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখি চারপাশে এত কুমারী মায়ের গল্পের ভীড়ে বেড়ে ওঠা ম্যাথিও এবং লুকের মনের পর্দায়। তাই মনে করা হয় এই সব প্রচলিত কাহিনিগুলো প্বার্শচরিত্রের মত বড় অনুপ্রেরণা ও সাহায্য যুগিয়ে গেছে ম্যাথিও এবং লুককে কুমারী মায়ের গল্পের মত অলৌকিক কথায় বিশ্বাসী হতে।
ম্যাথিও এবং লুকের বিশ্বাসের এই বীজ শেষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি শুধু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমেই দেশ কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা সংক্রমিত হয়েছে মরুর কোলে জন্ম নেওয়া একি ধর্মবৃক্ষের নতুন শাখা ইসলামে। আদর্শে ভিন্নতা থাকলেও পূর্ববর্তী নবীর পদাঙ্ক স্বীকার করে অনুসারীদের সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টায় অলৌকিক কাল্পনিক চরিত্র যিশুকে ঈসা নবীর মর্যাদায় আসন দিয়ে কুমারী মায়ের মত বিতর্কিত জন্মমতকে জোরালো সমর্থন জানাতে কার্পন্য করেনি ইসলামের নবী কোরানে-
সূরা মারইয়াম (১৯:১৬-২১)
এই কিতাবে মারইয়ামের কথা বর্ণনা করুন, যখন সে তার পরিবারের লোকজন থেকে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল। অতঃপর তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যে সে পর্দা করলো। অতঃপর আমি তার কাছে আমার রূহ প্রেরণ করলাম, সে তার নিকট পুর্ণ মানবাকৃতিতে আত্নপ্রকাশ করল। মারইয়াম বললঃ আমি তোমা থেকে দয়াময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করি যদি তুমি আল্লাহভীরু হও। সে বললঃ আমি তো শুধু তোমার পালনকর্তা প্রেরিত, যাতে তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করে যাব। মরিইয়াম বললঃ কিরূপে আমার পুত্র হবে, যখন কোন মানব আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও কখনও ছিলাম না ? সে বললঃ এমনিতেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্যে সহজ সাধ্য এবং আমি তাকে মানুষের জন্যে একটি নিদর্শন ও আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ স্বরূপ করতে চাই। এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।
বাইবেলের যিশুকে ঈসা নবী এবং তাঁর virgin birth কে কৌশলগত কারণে অন্ধের মত সমর্থন করে গেলেও স্বার্থগত কারণে একি বাইবেলের যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র এবং ক্রুশবিদ্ধ হওয়াকে মোটেই সমর্থন করে না কোরান-
“বলুন, তিনি আল্লাহ, এক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই”। (কোরান ১১২:১-৪)
“আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি”। (কোরান ৪:১৫৬-১৫৭)
আহা! কি বিচিত্রই না বিশ্বাসের রকমফের!
(চলবে)
লেখক: রাজেশ তালুকদার,
লন্ডন থেকে.

Tuesday, March 20, 2012

পাহাড়পুরবৌদ্ধবিহারে পর্যটকের ভিড় বেড়েছে বাড়েনিআধুনিক পর্যটন সুবিধা


     নওগাঁর ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় বাড়লেও বাড়েনি আধুনিক পর্যটন সুবিধা। জানা গেছে, গত বছরের জুলাই মাস থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১ হাজার ১৪০ জন বিদেশি পর্যটক ও ১ লাখ ১৭ হাজার ৪শজন দেশী দর্শনার্থী এ বৌদ্ধবিহার পরিদর্শন করেছেন। এ ৮ মাসে বৌদ্ধবিহারে আসা দর্শনার্থীদের টিকিট বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৪শটাকা। এ বৌদ্ধবিহার থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হলেও এর উন্নয়নে সরকারের নেই কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দুঃখজনক হলেও সত্য এ ঐতিহাসিক স্থানকে ঘিরে এখনো আধুনিক পর্যটন সুবিধা গড়ে ওঠেনি। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভাল মানের হোটেল-মোটেলের অভাবে শুধু দেশের নয় বিদেশি পর্যটকরাও এখানে বেড়াতে এসে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন।
      এ বিহারে মোট ১৭৭টি ঘর রয়েছে। ঘরগুলোতে বৌদ্ধভিক্ষুরা বাস করতেন। বিহারের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি মন্দির। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৪শফুট, প্রস্থে প্রায় ৩৫০ ফুট ও উচ্চতায় ৭০ ফুট। কালের পরিক্রমায় মন্দিরের সবচেয়ে উপরের অংশ ধসে গেছে। বাইরের দেয়ালে বুদ্ধমূর্তি, হিন্দুদের দেবী মূর্তি ও প্রচুর পোড়ামাটির ফলকচিত্র রয়েছে। এসব চিত্রে সাধারণ মানুষের জীবনগাথা ও আদিম জীবনাচার চিত্রিত হয়েছে। বিহারের মূল বেষ্টনির দেয়াল প্রায় ২০ ফুট চওড়া। বেষ্টনির মধ্যে রয়েছে আরেকটি মন্দির। এছাড়া এর আশেপাশে আরো কিছু স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায়। বিহার থেকে ১৬০ ফুট দূরে রয়েছে ইট ও পাথর দিয়ে বাঁধানো একটি ঘাট। এ ঘাটের পাশ দিয়ে সে সময় প্রবহমান একটি নদী ছিল। নরওয়ে সরকারের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৩ সালে এখানে একটি যাদুঘর তৈরি করা হয়। এ যাদুঘরে খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলের রূপার মুদ্রাসহ বিভিন্ন সময়ের প্রাচীন মুদ্রা, কয়েক হাজার পোড়ামাটির ফলকচিত্র, পাথরের মূর্তি, তাম্রলিপি, শিলালিপি ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। এছাড়া বিহারের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও পর্যটকদের সহজেই আকৃষ্ট করে। এছাড়া জেলা সদর থেকে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার যাওয়ার রাস্তাটিরও করুণ অবস্থা। এ কারণে এখানে আসা পর্যটকদের প্রতিদিন চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিহারে কর্মরত কর্মকর্তা আবুল কালাম হোসেন জানান, বিহারের চতুর্দিকে বাউন্ডারি ওয়াল না থাকায় অনেক দর্শনার্থী টিকিট না করেই খোলা জায়গা দিয়ে প্রবেশ করে।
খবর ইত্তেফাক।
লেখক: মহাদেবপুর (নওগাঁ) সংবাদদাতা |
বুধবার , ২১ মার্চ ২০১২, ৭ চৈত্র ১৪১৮


Thursday, March 15, 2012

যিশুর জন্ম সমাচারঃ পর্ব ১


        ধরুন আপনাকে একটি জরিপের দায়িত্ব দেয়া হল, আপনার জরিপের বিষয়বস্তু- যিশুর জন্মদিন কবে লোকজনের কাছ থেকে তার উত্তর জিজ্ঞেস করা। নিশ্চিত ফলাফল আসবে, কেন ২৫শে ডিসেম্বর! আর একটু ফাজিল টাইপের কেউ হলে মনে মনে হয়তো বলবে “ওহ গড” এ আহাম্মক যিশুর জন্মদিন জানে না!

         খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বিদের বিশ্বাস ঈশ্বর পুত্র যিশু ঠিক এই দিনে পৃথিবীতে আগমন করেন স্বর্গ হতে বিতাড়িত আদম গুষ্ঠির মান ভাঙ্গিয়ে পুনরায় তাদের ঈশ্বরের অনন্ত সুখ রাজ্যে ফিরিয়ে নিতে, মানুষকে সকল দুঃখ যন্ত্রনার নাভিশ্বাস হতে মুক্ত করতে, শয়তানের সকল চক্রান্তের ফাঁক গলে চির অসহায় মানুষকে সত্যের পথে আনতে। এই দিনটি খৃষ্টান সম্প্রদায়ের কাছে তাই পরম আনন্দের। পরপারের ঈশ্বরের কাছে রওনা হতে পারার নিশ্চয়তার আনন্দকে সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে এই দিনটিকে ঘিরে তাঁর অনুসারীরা রাস্তাঘাট, গীর্জা, শপিংমল, বাড়ী-ঘর সহ সর্বত্র আয়োজন করে সাজ সাজ রব, উৎসবের তরী ভাসায় আনন্দের সাগরে। চারিদেকে মুহুর্মুহু আলোর ঝলকানি ও ক্রিসমাস ট্রির সুশোভিত ছায়ায় কিছুদিনের জন্য এক দৃষ্টি নন্দন ঝলমলে স্বর্গীয় আমেজের পরিবেশ তৈরী করে খুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় চিরচেনা বৈচিত্রময় পৃথিবীর বুকে। কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাস, প্রার্থনা, ছুটোছুটি, ব্যতিব্যস্ততাই এটা যেন প্রমাণ করার চেষ্টা করে এই সেই শুভদিন, যে দিনে ঈশ্বর পুত্র যিশু ধরণীতে অবতির্ণ হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে, শুধু মানব মুক্তির খাতিরে। অবশ্য সত্যান্বেষি ঐতিহাসিক ও অবিশ্বাসীদের কথা একেবারেই ভিন্ন। বরাবরি তাদের দাবী যিশু নামের কোন চরিত্র এই পৃথিবীতে জন্মই নেয়নি কোন কালে। যিশু কিছু মানুষের সৃষ্ট এক কাল্পনিক চরিত্র মাত্র। অন্যান্য ধর্ম পুরুষ যেমনঃ- মহাবীর, বুদ্ধ, মুহাম্মদের জীবণ, ধর্ম দর্শন নিয়ে প্রচুর সমালোচনা, বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বহু দ্বন্দ্ব আছে সত্য কিন্তু পৃথিবীতে তাঁদের জন্ম গ্রহণ নিয়ে তিল মাত্র সন্দেহ নেই কোন সমালোচকের। অপর দিকে যিশুর ক্ষেত্রে তাঁর ধর্ম দর্শনের সাথে সাথে পৃথিবীতে তাঁর জন্মটাই ঝুলে আছে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্নে।
কল্পনার রং তুলির আঁচড়ে আঁকা বলেই হয়ত একি মূল হতে উৎপন্ন অগ্রজ ইহুদীরা যিশুকে স্বীকার করে না একদম কিন্তু অনুজ ইসলাম যিশুকে ঈসা নবী বানিয়ে তাঁর নবীত্বের বিশ্বাসে রেখেছে পূর্ণ আস্থা। স্বীকৃতি পর্যন্ত ভক্তির দৌড় সীমাবদ্ধতা থাকায় মুহাম্মদ ছাড়া ঈসা বা অন্যকোন নবীর জন্ম ও মৃত্যু দিন পালন নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই, নেই কোন আগ্রহ, উৎসব, কেমন যেন গাছাড়া ভাব। অনেকটা মানাতে বাধ্য হয়ে মানা, এটাই যেন তাদের মনোগত চেতনার প্রতিফলন।
        এই প্রবন্ধে অবিশ্বাসীদের সব সমালোচনার দাবি আলোচনার বাইরে রেখে আমরা শুধু পর্যালোচনা করার চেষ্টা করব মাতৃগর্ভে ভ্রুণ গঠন ও জন্মদিন নিয়ে যিশু ভক্ত জীবন রচয়িতাকারিদের কার কি বিশ্বাস ও অভিমত তা নিয়ে।
যিশুর জন্ম বিষয়ক আলোচনার গভীরে ঢুকার আগে আমাদের সামান্য হলেও বুঝতে হবে Gospel কি?
খ্রীষ্টিয় ৫ম থেকে ১২দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংরেজী ভাষার প্রাচীণ রূপটিকে অবিহিত করা হয় অ্যাংলো-স্যাক্সান নামে। Gospel শব্দটি এসেছে ইংরেজী ভাষার এই প্রাচীণ অ্যাংলো-স্যাক্সান রূপ god-spell থেকে। যার অর্থ “সুসমাচার” বা “শুভ সংবাদ”, ঈশ্বর প্রেরিত প্রতিনিধি যিশুর মাধ্যমে যে বাণীগুলো প্রচারিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয় তাই Gospel. এই Gospel রচনাকারীদের মধ্যে খ্রীষ্টিয় অনুশাসন মতে মার্ককে বিবেচনা করা হয় প্রথম সুসমাচার রচনাকারী। তাঁর রচনা কাল খ্রীষ্টিয় ৬০-৮০ অব্দ। এরপরে আরো সুসমাচার লিখেন ম্যাথিও(Matthew), লুক (Luke), জন (Jhon)। মূলত তাঁদের বিশ্বাসের হাত ধরেই যিশুর জন্ম কাহিনি, শিক্ষা, মৃত্যু, পুনরুত্থান সহ যিশুর যাবতীয় ঘটনাবলি আজো উপস্থাপিত হয় বিশ্ববাসীর কছে। তাঁরা সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানে বাইবেলে Gospel গুলো রচনা করলেও ব্যক্তি মনন ও আপন স্বকীয় বিশ্বাসে পার্থক্য থাকায় তাঁদের লেখা বাণীগুলোর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে বেশ ভাল অমিল চোখে পরে। তবে একথা সত্য এই Gospel রচয়িতাদের মধ্যে কেউ কখনো যিশুর সফর সঙ্গী ছিলেন না কখনো, এমনকি কেউ নিদেনপক্ষে যিশুকে কাছ থেকে দেখেছেন বলে দাবিও তোলেন নি।
তাঁদের Gospel রচনাগুলো নিয়েও আবার আছে প্রচুর মতানৈক্য, আছে সংশয়। ইতিহাসবিদের দাবী-
        “All four Gospels are anonymous in the sense that none mentions the author’s name. The traditional names – Matthew, Mark, Luke and John – did not become associated with these writings until the second century. Whether or not these men were the actual authors is very controversial.”
         “লেখকের কোন নাম না থাকায় চারটি সুসমাচারকেই অজানা কোন লেখকদের লেখা মনে করা হয়। প্রচলিত নাম অনুসারে ম্যাথিও, মার্ক, লুক এবং জনকে সুসমাচার লেখক হিসাবে বলা হলেও খ্রীষ্টিয় ২য় শতক পর্যন্ত কোখাও এ সু সমাচার গুলোতে তাদের নাম যুক্ত না। তাই এই লোক গুলোই যে প্রকৃত লেখক তা নিয়ে রয়েছে প্রচুর সংশয়”।

ম্যাথিও এবং লু্ক যে সুসমাচার লেখেন তাকে বিবেচনা করা হয় মার্কের লেখা সুসমাচারের কার্বন কপি। তাঁরা যে কাজটি করেন তা হল মার্কের লেখা সুসমাচারকে আরো অধিক গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করতে মার্কের মূল ভাবকে প্রায় অবিকৃত রেখে রসদ হিসাবে তাতে কিছু কিছু বাক্য ও শব্দের সংষ্কার।

একটি ছোট উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
 Matthew 10:9-10
          Do not take along any gold or silver or copper in your belts; take no bag for the journey, or extra tunic, or sandals or a staff
Mark 6:8-9
       Take nothing for the journey except a staff – no bread, no bag, no money in your belts. Wear sandals but not an extrat unic.
Luke 9:3
          Take nothing for the journey – no staff, no bag, no bread, no money, no extra tunic.


         তাছাড়া ম্যাথিও এবং লু্ক আরো কিছু কিছু নতুন প্যারা তাতে যোগ করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচিত-সমালোচিত virgin birth প্রসঙ্গ। অর্থাৎ কোন পুরুষের সাথে কোন প্রকার যৌন সংসর্গ ছাড়া মা মেরীর জটরে যিশুর ভ্রুণ গঠন।
Virgin birth প্রসঙ্গে দেখা যাক ম্যাথিও কি বলেন।
    
          তিনি তাঁর সুসমাচারে বলেন, মেরী জোসেফের বাগদত্তা হওয়ার পরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেলেন, কিন্তু তখনো তাদের বিয়ে হয়নি।
সমস্যা বিয়ে হওয়া না হওয়া নিয়ে কথা নয় সমস্যা ছিল তাদের মধ্যে কোন রকম শারীরিক মিলন তখনো ঘটেনি। তাহলে মেরীর পেটে বাচ্চা আসা কি ভাবে সম্ভব! আপাত দৃষ্টিতে একে অবাস্তব একেবারেই অসম্ভব মনে হলেও বিশ্বাসীদের কাছে এই কাজটি সহজে সম্ভব হয়েছিল এক অলৌকিক পবিত্র সত্ত্বার মাধ্যমে।
Matthew 1:18
        “she was found to be with child through the Holy Spirit.”
(তাঁকে পবিত্র সত্ত্বা দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পাওয়া যায়)

          মেরীর অন্তঃসত্ত্বার খবরে মেরীর সাথে কোন প্রকার শারীরিক সম্পর্ক না করা জোসেফের মুষড়ে পড়াই স্বাভাবিক ছিল। হয়েছেনো তাই, রাগে ক্ষোভে হতাশায় সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তিনি এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চাইলেন। হাজার হলেও তিনিতো রক্তমাংসের মানুষ। লোক সমাজে মান সন্মান বলে কথা। এই সব দুশ্চিন্তার ভার মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ফাঁকে তাঁর এই মনের অস্থিরতা দূর করতেই এক দেবদূতের আগমন ঘটে স্বপ্নে। সেই দেবদূত সবিস্তারে খুলে বলা কথায় জোসেফ শান্ত হলেন। মন থেকে সন্দেহ মুছে দিয়ে জোসেফ রাজি হলেন মেরীকে বিয়ে করতে।
Matthew 1:19-24
        Joseph wanted to back out of the marriage after he found out about the pregnancy. But then an angel appeared to him in a dream, told him about Jesus, and convinced him to accept Mary as his wife

         (জোসেফ যখন জানতে পারলেন অন্তঃসত্ত্বার বিষয়ে তিনি এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চাইলেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের মধ্যে এক দেবদূত দেখা দিল, তিনি তাঁকে যিশু সম্পর্কে বলল্লেন, এবং মেরীকে স্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে রাজী করালেন)

          ঈশ্বর পুত্র কল্পনায় ম্যাথিও এতটাই বুদ হয়েছিলেন যে যিশুর জন্মটা সাধারণ মানুষের মত কোন ক্রমেই স্বাভাবিক নরনারীর মিলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে তা মানতে পারেন নি। হয়তো তিনি যৌনতাকে মনে করতেন অপবিত্র অসূচি কাজ। তাঁর বদ্ধ বিশ্বাস ছিল পবিত্র পুরুষের জণ্মতো আর চোরের মত চুপিচুপি যৌনকাজ দিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। হোক না তারা স্বামী স্ত্রী তাতে কি!
তিনি যৌনতাকে কত অপবিত্র মনে করতেন তা আরো স্বচ্ছতা পায় তাঁর নীচের কথাতেই।
Matthew 1:25

        “had no union with her until she gave birth to a son”
(তিনি সন্তান জন্ম না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের মিলন ঘটেনি)

          উপরের বাক্য থেকে যিশুর জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে স্বামী স্ত্রী হিসাবে স্বাভাবিক যৌন মিলন ঘটাতে তাঁর যথেষ্ট আপত্তি ছিল তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কারো। যিশুর জন্মটাকে এত অস্বাভাবিক ভাবে অতি পবিত্র করণ করতে গিয়ে তাঁর জন্মটাকেই ম্যাথিও প্রশ্ন বিদ্ধ করে গেলেন তা বুঝার বোধটুকুও বিশ্বাসীদের অবশিষ্ট না থাকলেও এক সময় তা অন্যদের কাছে বিরাট প্রশ্ন বোধক চিহ্ন হয়ে দেখা দেয়।
এবার আমরা দেখি virgin birth প্রসঙ্গে আরেক সুসমাচার রচয়িতা লু্কের ভাষ্য।
লুকি বলেন, দেবদূত জেব্রাইল মেরীর নিকট আগেই এসে জানান দিলেন-“ পবিত্র সত্ত্বা আপনার নিকট আসবে এবং সর্বোচ্চ শক্তি আপনার উপর আশ্রিত হবে, তাই যে শিশু জন্ম নিবে তাকে ডাকা হবে পবিত্র- ঈশ্বরের পুত্র”।

Luke 1:35-38
         says that the angel Gabriel visited her beforehand and told her that “the Holy Spirit will come upon you, and the power of the Most High will overshadow you. therefore the child to be born will be called holy—the Son of God. ”

মেরী দেবদূতকে জিজ্ঞেস করলেন “ এটা কি ভাবে সম্ভব, আমি যে এখনো কুমারী”
34 And Mary said to the angel, “How will this be, since I am a virgin?”

দেবদূত বলল্লেন “ঈশ্বরের কাছে অসাধ্য কিছু নাই”
37 For nothing will be impossible with God.”

         অথচ যিশুর জন্ম সংক্রান্ত এত গুরুত্বপূর্ণ virgin birth মার্ক কখনো উল্লেখ করেননি তাঁর প্রচারিত সুসমাচারে। তাহলে এত বড় তথ্য মার্ক কি সত্যি ইচ্ছে করে চেপে গেলেন? চাপলে কেন চেপে গেলেন? তিনি কি চান নি আসল সত্য লোকজন জানুক? এই সব প্রশ্নের ছুটে আসা তীরের দিক পরিবর্তন করতে স্মরণাপন্ন হওয়া যাক সেইন্ট পলের। তার পূর্বে খানিকটা জেনে নিই কে এই পল, কি সেইন্ট পলের কীর্তি।
ঐতিহাহিকদের ধারণা old testament উৎপত্তি হয়েছে খ্রীষ্টিয় ১৫০০-৪০০ বছর আগে প্রায় ৩৯ টি বইয়ের সমন্বয়ে যা লিখিত হয়েছে মূলত হিব্রু ভাষায় এবং কিছু আরামায়িক(Aramaic) ভাষায়। প্যালেষ্টাইন অঞ্চলের আমজনতার ভাষা ছিল এই Aramaic। অপর দিকে গ্রীক ভাষায় new testament লিখিত হয়েছে ২৭ টি বইয়ের সমন্বয়ে। বাইবেল সম্পর্কিত দলিল দস্তাবেজ ঘেটে ঐতিহাসিকরা এমন দাবি করেন এই ২৭টা বইয়ের মধ্যে নাকি ১৩টাই সেইন্ট পলের লেখা। পলের ভুমিকা এখানেই শেষ নয়, বিশ্বাস করা হয় চার সুসমাচার রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম লুকি এই পলের সাথে সঙ্গি হয়ে ধর্ম প্রচারে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন অসংখ্যবার। শুরুর দিকে নানান জটিলতা এড়িয়ে একটি নতুন ধর্মীয় মতবাদকে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা উপযোগী করে একটি প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য মজবুত অবস্থানে নিয়ে যেতে পল হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করেন। অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন জন সাধারণের দোরগোড়ায় ঈশ্বরের বাণী বা যিশুর বাণী পৌঁছে দিতে। তাই যিশু সম্পর্কে যে কোন আলোচনায় সেইন্ট পলের ভাষ্যকে বিবেচনায় না আনলে তার গ্রহণ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। খ্রীষ্টিয় ৪৯-৫৫ অব্দে খৃস্ট ধর্মের এই নিবেদিত প্রাণ পল তাঁর লেখা সুসমাচারে ঘোষণা করেছিলেন যিশু জন্মেছিলেন আর দশ জন সাধারণ মানুষের মত, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। তিনি বলেন-

Galatians 4:4,
            “But when the time had fully come, God sent his Son, born of a woman, born under law.
             “(যখন সময় পূর্ণ হল ঈশ্বর তাঁর পুত্রকে পাঠালেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মাতৃগর্ভে)

           উপরের বক্তব্যটি বিশ্বাসীদের কারো কাছে ধোঁয়াশা মনে হতে পারে তাই আনুমানিক ৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পল অন্য এক লেখনিতে যিশুকে ঈশ্বর পুত্র বলে সম্বোধন করলেও স্পষ্ট জোড়ালো ভাষাতে ডেভিড জোসেফের বীর্য হতে যিশুর জন্ম হয়েছে বলে মত প্রকাশ করে গেছেন
            “I Paul, a servant of Jesus Christ, called to be an apostle and separated onto the gospel of God…concerning his Son Jesus Christ our Lord, which was made of the seed of David according to the flesh.”
          “আমি পল, যিশু খ্রীষ্টের দাস, যাকে যিশুর অন্যতম শিষ্য ও অন্তঃপ্রাণ ঈশ্বরের বাণী প্রচারক হিসাবে বিবেচিত করা হয় … তাঁর পুত্র যিশু খ্রীষ্ট আমাদের পালনকর্তা, যিনি ডেভিড এর বীজ থেকে ভ্রুনে পরিণত হয়েছেন.”

এ তো গেল পলের মতামত।
         এই বার আমরা দেখি সর্বশেষ Gospel রচয়িতা জন কি বলেন virgin birth প্রসঙ্গে। ঐতিহাসিকদের দাবির প্রেক্ষিতে বলতে হয় জনের প্রচারিত বাণী গুলো কোন একক ব্যক্তির কথা নয়। সেগুলো ছিল একটি দলগত লেখকদের বিশ্বাসের বাণী। জন ছিলেন তাদের মুখপাত্র। বিতর্ক না গিয়ে আমি খ্রীষ্টিয় অনুশাসন মতে জনকে একক ব্যক্তিত্ব হিসাবে মেনে নিচ্ছি। তিনি ম্যাথিও ও লুকেরর virgin birth ধারনা একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন। অনুসারীদের মনে ম্যাথিও ও লুকির প্রচারিত virgin birth বিশ্বাসের উপর গড়ে উঠা দেয়ালে সজোরে কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিলেন জন। তিনি বিশ্বাস করতেন যৌনক্রিয়া ছাড়া কোন সন্তানের জন্ম হওয়া একে বারেই অসম্ভব। তিনি মনে করতেন virgin birth এটা শ্রেফ একটা ভ্রান্ত ধারনা। যদিও খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নি তবে চেষ্টা করেছিলেন মিথ ভাঙ্গতে। না পারার কারণটা পরে ব্যখ্যা করব।
John 1:45
          they refer to Jesus specifically as “the son of Joseph.”
তাঁদের মতে জেজাস শুধু জোসেফের পুত্র

John 6:42
            has the townspeople ask: “Is this not Jesus, the son of Joseph, whose father and mother we know?
          শহরের লোকদের কি জিজ্ঞেস করা হয়নি “একি সে জেসাস নয়, যে জোসেফের পুত্র, যার বাবা মাকে আমরা জানি”?

ইতিহাসবিদদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ইতিহাস খনন করে যুক্তি তর্ক ও প্রমাণের মুক্ত বায়ুতে ম্যাথিও, মার্ক, লুক এবং জন এই চার জন ছাড়াও আরো কিছু সুসমাচার লেখকের কথা পুনরুত্থান ঘটাতে সক্ষম হন। এদের মধ্যে একজন হলেন থমাস।
         ধারনা করা হয় থমাসের সুসমাচারটি প্রথম লিখিত হয়েছিল আনুমানিক ৭০ খৃষ্টাব্দে। যা মার্কের লেখা প্রথম সুসমাচারটির সমসাময়িক বলা যায়। এই সুসমাচারটির লিখিত ভাষা ছিল গ্রিক। ১৯০০সালে প্রথম এর তিনটি খন্ড আবিষ্কৃত হয়। পরে ঘটনাচক্রে ১৯৪৫ সালে মাটি খুড়ে “নাগ হামাদি” লাইব্রেরী আবিষ্কৃত হলে এর একটি সম্পূর্ণ লিখিত অংশ কপ্টিক অর্থাৎ মিশরীয় ভাষার অনুদিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়। দূর্ভাগ্য বলতে হয় থমাসের, কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ায় আধুনিক খ্রিষ্টান অনুশাসনে এই সুসমাচারের স্বীকৃতি আর মিলেনি। কিন্তু ঐতিহাসিকরা যিশুর জীবন সম্পর্কিত প্রচলিত বিবর্তনিয় বিশ্বাসের একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ দলিল ঠিকি হাতে পেয়ে যান। এটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য জন এবং ম্যাথিও প্রচারিত সুসমাচার থেকে এটি অনেক স্বাধীন মতামত প্রতিনিধিত্ব করে। বলাবাহুল্য virgin birth নিয়ে থমাসও কিছুই বলেন নি।
আরো একটি কাল্পিত সুসমাচার নথির উপর ইতিহাসবিদেরা বিশ্বাস রাখেন। যাকে অভিহিত করা হয় হারিয়ে যাওয়া নথি হিসাবে। এর জার্মান নাম Quelle যার অর্থ “উৎস”, সংক্ষেপে বলা হয় Q সুসমাচার। এর কোন পূর্ণাঙ্গ নথি এখনো পর্যন্ত পাওয়া না গেলেও ম্যাথিও ও লুকের রচিত সুসমাচার বিশ্লেষণ করে Q সুসমাচারের প্রতি ইতিহাসবিদেরা পূর্ণ আস্থা রাখেন। তাঁদের দাবি ম্যাথিও ও লুক অনেক কিছু মার্কের সুসমাচার থেকে ধার করলেও তাতে এমন অনেক কথা বলেছেন যা মার্ক কখনো উল্লেখ করেননি তাঁর লেখায়। তাহলে প্রশ্ন আসে ম্যাথিও এবং লুক এসব কথা পেলেন কোন উৎস থেকে? আগেই বলেছি যিশুকে তো তাঁরা দেখেন নি। তাহলে বক্তব্য গুলোর উৎস কি? এই প্রশ্নের যুতসই জবাব খুঁজতেই ইতিহাসবিদেরা Q সুসমাচারে ভরসা রাখেন। তাঁরা মনে করেন প্রচলিত মার্ক, ম্যাথিও, লুক, জনের লেখা সুসমাচার গুলোর বহু পূর্বে অর্থাৎ খ্রীষ্টধর্ম শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে মৌখিক বা লিখিত ভাবে যিশুর আগমন, শিক্ষা, মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ক Q সুসমাচার অস্থিত্ব বিদ্যমান ছিল পরে কোন অদৃশ্য কারনে তা হারিয়ে যায়। এই Q সুসমাচারে যিশুর জন্ম, মৃত্যু, ক্রশবিদ্ধ হওয়া, পুনরুত্থান বিষয়ে নীরব থেকে জোর দিয়ে গেছে শুধু যিশুর শিক্ষা নিয়ে।
          তবে সব কথার মূল কথা বিশ্বাসের মূলোটা আমাদের হাতেই, আমরা কি বিশ্বাস করব সেইন্ট পল, মার্ক ও জনের দাবি অনুসারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যিশুর জন্ম কাহিনি নাকি মেনে নেব যিশুর নতুন জন্ম কাহিনি লিখা ম্যাথিও ও লুকের আরোপিত virgin birth এর।
কথায় আছে- বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। 


তথ্য সংগ্রহঃ ইন্টারনেট
লিখেছেন: রাজেশ তালুকদার
লন্ডন  থেকে.

নালন্দার ধ্বংস বনাম ধর্মীয় বিজয়



        উপ মহাদেশের ইতিহাস বিশাল বৈচিত্রে ভরপুর। এখানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠি ধর্মের নানা মুখি সংঘাত ও সংমিশ্রণের ইতিহাস, একই সাথে আছে শিক্ষা সভ্যতার প্রগতি ও বিলয়ে ভরা ইতিহাস।মধ্য যুগে এই ইতিহাস রচনায় কান্ডারি ছিলেন বৌদ্ধ নৃপতি গণ। সংসার ত্যাগী বুদ্ধ মতবাদের প্রচার প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে তারা রাজ্য জুড়ে স্থাপন করেছেন অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার। এই সব বিহার থেকে কিছু কিছু বিহার পরে অবাধ জ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের খোলস ছাড়িয়ে হাজার বছর আগে খ্যাতি পেয়েছিল বিশ্ব বিদ্যালয়ে রূপে। তার মধ্যে-

বিক্রম শীলাঃ- ভারতের ভাগলপুর জেলার আন্টিচক, মাধোরামপুর, উরিয়াপ এই তিনটি গ্রাম নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছিল।


সোমপুরঃ- বাংলাদেশের নওগাঁয়।

ওদন্তপুরীঃ-মগধে অবস্থিত ছিল। পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অঞ্চল নিয়ে মগধ রাজ্য গঠিত ছিল।

জগদ্দলঃ- বীরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থিত ছিল। বাংলাদেশের রাজশাহী, পঞ্চগড়, ঠাকুর গাঁও, দিনাজপুর, নওগাঁ এবং ভারতের মালদা নিয়ে গঠিত ছিল।কোন কোন ঐতিহাসিক জগদ্দল নওগাঁয় আবার কেউ জগদ্দল কে দিনাজপুরে স্থাপিত হয়েছিল বলে মত প্রকাশ করেন, তবে যেখানেই হোক না কেন সেটা যে বাংলাদেশের ভূখন্ডেই ছিল সেটা নিশ্চিত।


তক্ষশীলাঃ-পাকিস্তানে আবস্থিত ছিল। বর্তমান ইসলামাবাদের ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ও রাওয়ালপিন্ডির কিছু উত্তরপশ্চিমে। প্রাচীন ভারতের অর্থশাস্ত্রের জনক বলে খ্যাত চাণক্য এখানেই লেখা পড়া করেন। শিক্ষা শেষে তিনি এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের আচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন।
নালন্দার মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবকাঠামোর ভিত্তি ভূমি স্থাপন করে দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ শাসকরা আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার যে রাস্তা তৈরী করে গিয়েছিলেন সেখানে থেকে আমরা কেন আলোর পথ পরিহার করে অন্ধকারের পথে হাটা শুরু করলাম? এই কেন প্রশ্নের উত্তর খোজা শুরু করলে সর্ব প্রথম যে সহজ সরল উত্তরটি আমাদের সামনে ভেসে আসে তা হল ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসা।বৌদ্ধ শাসন আমলে হিন্দু ব্রাহ্মন দের আয় রোজগারের পথ বন্ধ হওয়ায় ও সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পাওয়ায় তাদের মনের ভিতর যে আগুন বংশ পরম পরায় হাজার বছর ধরে গোপনে অতি কষ্টে সংরক্ষিত ছিল তার বিষ্ফোরন ঘটায় হিন্দু রাজাদের শাসনামলে এসে। সুযোগ হাতে পেয়েই তারা নিরীহ প্রগতি শীল বৌদ্ধদের নির্মম অত্যাচার, উৎপীড়ন, দমন ও হত্যা করে ভারত বর্ষ থেকে বিতাড়িত করে। রাজ আনুকুল্য বন্ধ করে ধস নামায় এই সব সার্বজনীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, উপরন্তু ব্রাহ্মন্য বাদের পূর্ণ কর্তত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জোড়ালো করেছিল দেবদাসী, সহমরণ ও তীব্র জাতি ভেদ প্রথার মত ঘৃণ্য সব প্রথার।
ব্রাহ্মন্যবাদের আলোচনা সমালোচনা করা আমার মুখ্য বিষয় নয়।প্রারম্ভিক কথাগুলো কান টানলে মাথা আসার মতই। আমার আলোচনা নালন্দার সফল অগ্রগতি ও শেষে করুণ পরিণতি নিয়ে।
পাল রাজাদের শাসন আমলে সোমপুর, বিক্রমশীলা ও নালন্দা একি প্রশাসনের অধীনে কাজ করত। প্রয়োজনে শিক্ষকরা এই তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া করে উন্নত শিক্ষার মান বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এবং ভারতীয় ইতিহাসবিদ প্রজ্ঞাবর্মণ গুপ্ত রাজা কুমারগুপ্তকে নালন্দা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করে গেছেন।খনন কার্যে প্রাপ্ত একটি সীলমোহর থেকেও এই দাবীর পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়।“নালন্দা” শব্দটি এসেছে “নালম” এবং “দা” থেকে।“নালম” শব্দের অর্থ পদ্ম ফুল যা জ্ঞানের প্রতীক রূপে প্রকাশ করা হয়েছে আর “দা” দিয়ে বুঝানো হয়েছে দান করা।তার মানে “নালন্দা” শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “জ্ঞান দানকারী”, প্রতিষ্ঠান টি প্রায় ৮০০ বছর ধরে জ্ঞান বিতরনের মত দুরূহ কাজটি করে গেছে নিরলস ভাবে।
নালন্দা ঠিক কবে স্থাপিত হয়েছিল তা আজ সঠিক ভাবে বলা হয়তো সম্ভব নয়। কোথাও পেলাম ৪২৭ খ্রীষ্টাব্দ আবার এক জায়গায় পেলাম ৪৫০ তা যা হোক ধরে নিলাম ৪২৭ থেকে ৪৫০ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময়ের মধ্যে এটি স্থাপিত হয়ে থাকবে।

এই বিশ্ব বিদ্যালয়টির অবস্থান ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত “বড়গাঁও” গ্রামের পাশেই। পাটনার আদি নাম পাটালিপুত্র।দুই হাজার তিনশ বছর আগে মৌর্যদের রাজধানী ছিল এই পাটালিপুত্র।সম্রাট অশোক এখান থেকেই রাজ্য পরিচালনা করতেন বলে জনশ্রুতি আছে।“বিহার” শব্দের অর্থ “বিচরণ”, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যেখানে অবস্থান করেন বা বিচরণ করেন তাকে বলে “বৌদ্ধ বিহার”, প্রাচীণ বৌদ্ধ সভ্যতার স্বর্ণ যুগে এই অঞ্চলে প্রচুর বৌদ্ধ বিহারের উপস্থিতি থাকায় পরবর্তীতে ভারতের এই রা্জ্যের নাম করন হয়েছে “বিহার”, মৌর্যদের পর বিহার চলে আসে গুপ্ত রাজাদের শাসনে।পরে মোগল সম্রাট আকবর ১৫৭৪ সালে বিহার দখল করেন।মোগলদের পর বিহার হাত বদল হয়ে আসে নবাব দের দখলে।নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে ইংরেজরা এর বিহার দখল নেয়। ১৯১১ সালে বাংলা থেকে বিহার ও উড়িষ্যা পৃথক হয়।
নালন্দা প্রাথমিক অবস্থায় ছিল একটি মহা বিহার।যেখানে মূলত বৌদ্ধ দর্শনের খুটি নাটি, বুদ্ধের শিক্ষা, বুদ্ধের অনুশাসন বিষয়ে পাঠ দান চলত। স্থিতিশীল রাজ্য পরিচালনা, দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বিকল্প নেই একটি সভ্য, উন্নত ও প্রগতিশীল মনন সম্পন্ন জাতির। যা তৈরী করতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই যথেষ্ট নয় এসত্য সম্যক ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তৎকালীন নেতৃস্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বৌদ্ধ শাসকরা। তাদের যৌথ আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে বৌদ্ধ ধর্মের পাশা পাশি তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার উপযোগী, সাহিত্য, সংষ্কৃতি ও আন্তর্জাতিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আরো অনেক শাখা যুক্ত করে তারা নালন্দাকে ধর্মের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। সম্রাট অশোক এখানে একটি বিহার তৈরী করেন।গুপ্ত সম্রাটরাও কয়েকটি মঠ নির্মাণ করে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন। মূলত গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্তের আমলেই এই মহা বিহারটির পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন ও বাংলার পাল সম্রাট গণ পৃষ্ঠপোষকতা করে বিশ্ব বিদ্যালয়টিকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যান।
নালন্দাকে তাঁরা গড়ে তুলে ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আবাসিক বিশ্ব বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা হিসাবে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই নালন্দায় লেখা পড়ার সুযোগ পেত না।এর জন্য প্রয়োজন হত শিক্ষার্থীর যোগ্যতার। শিক্ষার্থী সত্যিই নালন্দায় লেখাপড়া করার যোগ্য কিনা তা প্রমানের জন্য প্রবেশ দ্বারে দিতে হত মৌখিক পরীক্ষা। সাফল্যের সাথে এই ভর্তি পরীক্ষায় উতরে গেলেই মিলত এখানে বিদ্যা লাভের নিশ্চয়তা। পরীক্ষা মোটেই সহজ ছিল না। এতটাই কঠিন ছিল প্রতি দশ জনে মাত্র তিন জন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারত। ভাবতে অবাক লাগে তৎকালীন সময়ে নালন্দায় বিদ্যা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০ তাদের শিক্ষাদান করতেন প্রায় আরো ২,০০০ শিক্ষক। গড়ে প্রতি ৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন শিক্ষক ।কত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রের বিদ্যা দান সম্ভব তাও আবার থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থাসহ, ভেবে সত্যি অবাক না হয়ে উপায় নেই। এই বিশ্ব বিদ্যালয়টির বিশাল খরচ চালানোও যেন তেন বিষয় ছিল না। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় যাতে নালন্দার প্রশাসনকে কারো উপর নির্ভরশীল হতে না হয় সেদিক বিবেচনা করে ২০০ গ্রামকে শুধু মাত্র নালন্দার ব্যয় মিটানোর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্যা উৎসাহী বৌদ্ধ শাসকরা। এই সব গ্রাম গুলোর অবস্থান শুধু নালন্দার আশে পাশে ছিল না, ছিল সমগ্র বিহার রাজ্যের ৩০টি জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চিনতে পারার সুবিধার্থে বিশেষ চৈত্য বা স্তূপ তৈরী করে গ্রাম গুলোকে পৃথক করে রাখা হয়েছিল অনান্য গ্রাম থেকে। এই সব গ্রামের করের টাকা থেকেই ছাত্র ও শিক্ষকদের খাদ্য দ্রব্য সহ প্রয়োজনীয় সব খরচের যোগান আসত।
বাইরের কোন প্রকার উটকো ঝামেলা যাতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশের বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সেজন্য উঁচু লাল ইটের বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা ছিল সমগ্র বিশ্ব বিদ্যালয় চত্বর। ভিতরে ঢুকার জন্য ছিল বিশাল প্রবেশ দ্বার। বিদ্যালয় টিতে ছিল ৮ টি ভিন্ন ভিন্ন চত্বর, শ্রেণী কক্ষ, ধ্যান কক্ষ এবং দশটি মন্দির। বিদ্যালয়টির শিক্ষার প্রাকৃতিক পরিবেশ যথাসাধ্য স্নিগ্ধ ও কোমল রাখতে সমগ্র বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে তৈরী করা হয়েছিল বেশ কিছু সুরম্য উদ্যান যেগুলো ভরা ছিল বিচিত্র ফুল ফলের গাছ দিয়ে। গোসল ও প্রয়োজনীয় পানির সুবিধার জন্য খনন করা হয়েছিল কয়েকটি দীঘি। ছাত্রদের জন্য ছিল ছাত্রাবাস। পানির সমস্যার জন্য ছাত্রদের জ্ঞান অর্জনে যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেদিকটা মাথায় রেখে প্রতিটি ছাত্রাবাসে পানীয় জলের অসুবিধা দূর করতে তৈরী করা হয়েছিল বেশ কিছু কুয়ো। মোট কথা সমগ্র নালন্দা ছিল নিখুত পরিকল্পনায় গড়া একটি শিক্ষা স্বর্গ।











বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও পাঠ দান কক্ষ
      
         বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি বেধ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষ বিদ্যা, শিল্প কলা, চিকিৎসাশাস্ত্র সহ তৎকালীন সর্বোচ্চ শিক্ষা ব্যাবস্থার উপযোগী আরো বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত পাঠ দান চলত এখানে। শিক্ষকদের পাঠ দান আর ছাত্রদের পাঠ গ্রহণে সর্বদা মুখরিত থাকত এই বিদ্যাপীঠ। নালন্দার সুশিক্ষার খ্যাতির সুবাতাস এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে অনুন্নত প্রতিকুল এবরো থেবরো যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনি সুদূর তিব্বত, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, গ্রীস তুরষ্ক থেকে ছুটে আসা বিদ্যা অনুরাগীদের।










নালন্দার লাইব্রেরী

         ছাত্রদের প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব দূরীকরন এবং একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন শাখার জ্ঞানের সমাবেশ ঘটাতে তৈরী করা হয়েছিল তিনটি সুবিশাল লাইব্রেরী। লাইব্রেরী ভবন গুলো পরিচিত ছিল যথাক্রমে রত্ন সাগর, রত্ন দধি ও রত্ন রঞ্জক নামে। লাইব্রেরীর নাম করণ থেকে অনুমান করা যায় নালন্দার শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতা। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর মতে এখানে যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাদের জ্ঞানের খ্যাতি প্রসারিত ছিল বহুদূর ব্যাপি, চারিত্রিক দিক দিয়েও তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ চরিত্রের অধিকারী। র্নিলোভী এই শিক্ষকরা ভাল করেই অবগত ছিলেন বহুদূর দূরান্তের ছাত্ররা বন্ধুর পথের কষ্ট মাথায় নিয়ে তাঁদের কাছে ছুটে আসতেন বিদ্যা পিপাসায়। তাই তাঁরাও আন্তরিকতার সাথে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন। লাইব্রেরীর প্রতিটি ভবনের উচ্চতা ছিল সুবিশাল প্রায় ৯ তলা বিশিষ্ট দালানের সমান। এত বিশাল ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরী বর্তমান শিক্ষা সংষ্কৃতি ও ছাপাখানা প্রযুক্তির সহজ লভ্য যুগেও সচরাচর দেখা যায় না। প্রায় ৮০০ বছর ধরে লাইব্রেরী গুলো ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়েছিল হাজার হাজার পুঁতি, ধর্মীয়, জ্ঞান বিজ্ঞানের বই, চিকিৎসা শাস্ত্র, ও নানান গবেষনা লব্ধ মূল্যবান বই দিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লিখিত জ্ঞান বিজ্ঞানের বই গুলো এখানে অনুদিত হত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান গরিমায় আর পান্ডিত্যে যারা সে সময়ে উচ্চ পর্যায়ের ছিলেন তাঁরাই ভারত বর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নালন্দায় সন্মিলিত হয়েছিলেন জ্ঞান আহরন ও বিতরনের জন্য, ছাত্ররাও ছিল প্রাণবন্ত, শ্রদ্ধাবান, সুযোগ্য ও বিদ্যা উৎসাহী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সবাই এখানে সমবেত হওয়ার কারনে, ভিন্নতা ছিল তাদের ভাষায়, ভিন্নতা ছিল তাদের ধর্মে, ভিন্নতা ছিল তাদের সংষ্কৃতিতে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। এই উদ্দেশ্যই তাদের করেছিল বিনয়ী ও একতা বদ্ধ।
প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয় এক সময় এত সুবিশাল একটি বিশ্ব বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেছিলেন বাংলাদেশের সন্তান শীল ভদ্র। যিনি ছিলেন হিউয়েন সাঙ এর গুরু।প্রায় ২২ বছর হিউয়েন সাঙ তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চান্দিনাতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। আরো একজন বঙ্গীয় স্বনাম ধন্য পন্ডিত ব্যক্তির কথা উল্লেখ না করে উপায় নেই তিনি হলেন ঢাকার বিক্রমপুরে বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করা অতীশ দীপঙ্কর। বর্তমানে অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান “নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা” নামে পরিচিত। তিনি ১৫ বছর ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারের শিক্ষকতা ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন বেশ সফলতার সাথে।
শত শত বছর ধরে অবদান রেখে আসা একটি সভ্য, উন্নত জাতি তৈরী ও জ্ঞান উৎপাদনকারী নিরীহ এই প্রতিষ্ঠানটি ১১৯৩ খ্রষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী আক্রমন করে ধ্বংস করে ফেলেন। তার আক্রমনের বর্বরতা এত ভয়াবহ আকারে ছিল এ সম্পর্কে পারস্য ইতিহাসবিদ মিনহাজ তাঁর “তাবাকাতে নাসিরি” গ্রন্থে লিখেছেন “হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করেন খিলজী” এরপর আগুন লাগিয়ে দেন লাইব্রেরীর ভবন গুলোতে। লাইব্রেরীতে বইয়ের পরিমান এত বেশী ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহা মূল্যবান বই গুলো পুড়ে ছাই ভষ্ম হতে(জনশ্রুতি আছে ছয় মাস) খিলজী শুধু নালন্দাকে পুড়িয়ে ছাই করেন নি, একই সাথে পুড়িয়ে ছাই করেছেন একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আমরা জানতে পারতাম সে যুগের ভারত বর্ষের শিক্ষার অবকাঠামো, তৎকালীন সামাজিক-সাংষ্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে। জাতি হিসাবেও হয়তো আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে সহস্র বছর। সেদিন তার ধারালো তরবারির নিষ্ঠুর আঘাতে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া নিরস্ত্র মানুষের আর্ত চিৎকারে ও জীবন্ত মানুষ পোড়া গন্ধের সাথে বাতাসে ভেসে আসা বাচঁতে চাওয়া ঝলসানো সাধারণ মানুষ গুলোর করুণ আর্তনাদে স্তব্ধ হয়েছিল একটি সভ্য জাতির অগ্রযাত্রা।
খিলজীর এই পাশবিক নিষ্ঠুর বর্বরতাও পরিচিতি পায় এক শ্রেণীর ধর্মান্ধদের চোখে ধর্মীয় বিজয় হিসাবে!
এই পোড়া ভগ্ন স্তুপ থেকে নালন্দাকে আবারো মাথা তুলে দাঁড় করানোর শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন মুদিত ভদ্র নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু কিন্তু এইবার পুন:রায় তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় ঈর্ষার আগুনে জ্বলতে থাকা দুই ক্ষু্ব্ধ ধর্মান্ধ ব্রাহ্মন। এখানে আবারো ঘটে আরেক সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় বিজয়!
নালন্দায় বার বার ধর্মীয় বিজয় সফল হলেও লজ্জিত হয় মানবতা, পরাজিত হয় সভ্যতা, শৃঙ্খলিত হয় শিক্ষা।
এভাবে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা, আক্রোশ, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল ধর্মান্ধরা কয়েকশ বছর ধরে মানব সভ্যতাকে আলোর পথ দেখানো মানুষ গড়া্র এই কারখানাটিকে।
তথ্য সংগ্রহঃ ইন্টারনেট
লিখেছেন: রাজেশ তালুকদার
লন্ডন  থেকে.

Tuesday, March 13, 2012

দৃষ্টান্ত


ঙ্গজন, প্রকৃতিগত ভাবে, ছুটি-প্রিয়। তৈলঢালা স্নিগ্ধতনু ছুটি পাইলে ছাড়িতে চাহে না। ছুটির অছিলাও ছাড়ে না। যে কেহই বন্ধ ডাকুক, যে কেহই সেই কর্মনাশ রুখিবার ডাক দিক, বন্ধমাত্রেই সফলহয়। কারণ, সেই ছুটি। এই ছুটি-অন্ত-প্রাণ দেশে মুর্শিদাবাদ জেলার নসিপুর হাইমাদ্রাসার দৃষ্টান্তটি সত্যই এক বিরল ব্যতিক্রম। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় বিদ্যালয়ে ছুটিচলে। অথচ, সেই ছুটিই যে শেষ কথা নহে, চাহিলে তাহাকেও কর্মদিবস-এ রূপান্তরিত করা যায়, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাহাই প্রমাণিত হইয়াছে। প্রত্যন্ত গ্রামের এই মাদ্রাসার পড়ুয়াগণ তেমন সচ্ছল পরিবার হইতে আসেন নাই, বাড়িতেও পড়া দেখাইয়া দিবার যোগ্য ব্যক্তির অভাব, সুতরাং শিক্ষায়তন টানা কিছু দিন বন্ধ থাকিলে পাঠে বিঘ্ন ঘটিবার সম্ভাবনা বিস্তর। মুশকিল আসান হইলেন মাদ্রাসার শিক্ষকেরা। সন্ধ্যাবেলায় তাঁহারা মাদ্রাসারই কক্ষে পাঠদান শুরু করিলেন। কম্পিউটার, প্রজেক্টর ইত্যাদি সহযোগে রীতিমত মনোজ্ঞ করিয়া তুলিলেন সান্ধ্য-শিক্ষার আসর। যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এই মাদ্রাসা চলে, তাহার নিরিখে এই ধরনের কর্মকাণ্ড কার্যত নজিরবিহীন। ফল ফলিতে বিলম্ব হয় নাই। পড়ুয়াগণ মহানন্দে ছুটিফেলিয়া পাঠে শামিল। মাদ্রাসার শিক্ষকেরাও বৈধছুটির সন্ধ্যায় কাজে মগ্ন। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হইল।
এই উদাহরণ হইতে পশ্চিমবঙ্গ কিছু শিখিবে কি? শিখিবার ইচ্ছা আছে কি? সংশয় অমূলক নহে। একটি অভিযোগ বহুশ্রুত, এবং বহুচর্চিত। কাজ হয় না। প্রশ্ন উঠে, কেন হয় না? উত্তর, পরিকাঠামো নাই, তাই। প্রশাসন অমুক জিনিসটি দেয় নাই, তমুক কাজটি করে নাই, তাই। অমুকজিনিস এবং তমুককাজটি গুরুত্বপূর্ণ হইতেই পারে, কিন্তু তাহার অভাবে কাজকর্ম থামাইয়া বসিয়া থাকিতে হইবে কেন? দূর গ্রামের মাদ্রাসায় সান্ধ্যকালীন পাঠে প্রজেক্টরচলিতেছে, পর্দায় দক্ষিণ মেরুর ছবি পড়ুয়ারা সবিস্ময়ে দেখিতেছে, সহসা শুনিলে ইহাকে রূপকথা বা সিনেমার কাহিনি বলিয়া ভ্রম হইতে পারে। নসিপুর হাইমাদ্রাসা এই আপাত অবিশ্বাস্য কথাটিকে বাস্তব করিয়া দেখাইয়াছে। এবং স্বীয় চেষ্টায়। অসম্ভবটিকে সম্ভব করিবার জন্য প্রশাসনের কৃপাপ্রার্থী হয় নাই। পরিকাঠামো নাই বলিয়া হাত গুটাইয়া থাকে নাই। কর্তব্যশীল নাগরিক সমাজের নিজস্ব প্রয়াস কত দূর যাইতে পারে, ইহা তাহারই উজ্জ্বল প্রমাণ।
পরিকাঠামোর অভাব নিশ্চয়ই দূর করা চাই। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই এই অভাব হইয়া দাঁড়ায় অবহেলা বা অকর্মণ্যতার অজুহাত। এই অজুহাতে কাজ যতটা হইতে পারিত, তাহাও হয় না। একটি দৃষ্টান্ত। শিশুশ্রমিকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে যে কয়টি বিদ্যালয় থাকিবার কথা, তাহা নাই। যে কয়টি আছে, তাহারও দশা অতি করুণ। রাজ্যে স্বীকৃত হিসাব অনুসারে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক। বিশেষ বিদ্যালয়ে পড়ুয়ার নথিভুক্ত সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ সহস্রের কিছু বেশি। মোট শিশুশ্রমিক-সংখ্যার দশ শতাংশও নহে। কেন এমন অবস্থা, প্রশ্ন উঠিলে, পরিকাঠামোর কথা উঠিবে। নাগরিক সমাজ কেন উদ্যোগী হয় নাই, প্রশাসনের বাহিরে থাকিয়াও কিছু করা যায় কি না, তাহার চেষ্টা কেন করা হয় নাই, সেই কথাগুলি কেহই ভাবিতে চাহেন না। এই মনোভাব সর্বত্র। ইহার পরিবর্তন জরুরি। নসিপুর হাইমাদ্রাসা একটি গুণগত পরিবর্তন আনিয়া দেখাইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গীয়গণ শিখিলে রাজ্যেরই মঙ্গল হইবে।

২৯ ফাল্গুন ১৪১৮ মঙ্গলবার ১৩ মার্চ ২০১২
সম্পাদকীয় ২...খবর আনন্দবাজার পএিকা