Saturday, November 3, 2012

রামুর পথে - এ পশুশক্তিকে আমরা রুখবই


নাসির উদ্দীন ইউসুফ | তারিখ: ০৩-১১-২০১২
রামু বা উখিয়ায় যাওয়া সহজ এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। যাত্রাপথ দীর্ঘ নয়, সংক্ষিপ্ত। বিমানে কক্সবাজার, কক্সবাজার থেকে গাড়িতে রামু ৪০ মিনিট। উখিয়া ঘণ্টামতো। ছাত্রজীবনে গত শতকের ষাট বা সত্তরের দশকে ট্রেনে-বাসে তারপর চান্দের গাড়িতে। পথের ক্লান্তি-সময় সবকিছু হার মানত যৌবনের শক্তির কাছে। রামু-উখিয়া-টেকনাফ-কক্সবাজারের প্রাকৃতিক শোভা আর শতবর্ষের ঐতিহ্যমণ্ডিত বৌদ্ধমন্দির আর বুদ্ধমূর্তির নির্মল সৌন্দর্যের আকর্ষণে রামুর দীর্ঘ পথ সংক্ষিপ্ত হয়ে যেত।
কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২-এর পর রামু-উখিয়া যেন যোজন যোজন দূর এক জনপদ। রামু-উখিয়ার পথ যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। সহজে আর পৌঁছানো যায় না। প্রকৃতির কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়, এক প্রগাঢ় মানবিক বিষাদে রামু অগম্য দূর-দূরান্তের কোনো অচেনা এক জনপদ হয়ে গেছে। সেখানে আর সহজে যাওয়া যায় না। যদিও বা সব অবসাদ ঝেড়ে ফেলে যান রামু অথবা উখিয়ার বিধ্বস্ত জনপদে, তবে ছিন্ন মস্তক বুদ্ধ অথবা চোখ উপড়ে ফেলা বুদ্ধের খণ্ডিত মূর্তির সামনে ক্রমশ ক্ষুদ্র হতে থাকবেন। আপনার মনে পড়ে যাবে, মহান চেক লেখক ফ্রাঙ্ক কাফকার ‘মেটামরফসিস’-এর কথা। এক ক্ষুদ্র কীট হয়ে দেখবেন বুদ্ধের পায়ের কাছে চোখ উপড়ানো, ক্ষতবিক্ষত বুদ্ধের মুণ্ডু। কিন্তু তবু বুদ্ধ হাসছেন। শিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরি বুদ্ধের মূর্তি যেন সামপ্রদায়িকতার অনলে পুড়ে, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে আরও জীবন্ত, আরও সমাহিত। আগতজনকে বুদ্ধ যেন বা বলছেন, ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’। ‘অহিংসা পরম ধর্ম’।
আমার এই অনুভব আজ থেকে প্রায় তিন সপ্তাহ পূর্বের। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে রামু এবং উখিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে গিয়েছিলাম। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পোড়া বৌদ্ধবিহার, বসতবাটি, শত শত বর্ষের ঐতিহ্য তালপাতার পুঁথির ভস্মাবশেষ। এসব কিছুর সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো, পুড়েছে মানবতা, মুক্তিযুদ্ধ আর বাঙালির হাজার বছরের সাম্যের ঐতিহ্য আর আমাদের সংবিধান।
৩০ সেপ্টেম্বর দুপুর। আর দশটা দিনের মতো স্বাভাবিক ঢাকা। প্রচণ্ড জ্যামে বাংলামোটরের সামনে গাড়িতে বসা আমি। হঠাৎ মুঠোফোনে ঢাকা থিয়েটারের অভিনেতা শতদল বড়ুয়ার উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর। রামু এবং উখিয়ায় বৌদ্ধমন্দির ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চলছে কাল রাত থেকে। কতিপয় মুসলিম ঝান্ডাধারী প্রায় বিনা বাধায় রামুতে সারা রাত চালিয়েছে তাণ্ডব। এখন ছড়িয়ে পড়ছে উখিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ, পটিয়ার দিকে। শতদল দ্রুত বলে যায়, এ প্রান্তে আমার বোধের অগম্য তার ভয়াবহ বর্ণনা। ও আরও বলল, এক্ষুনি একবার প্রেসক্লাবের সামনে যদি যাই, তবে খুব উপকার হয়। ঢাকায় অবস্থানরত বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা মানববন্ধন এবং সম্প্রীতি সমাবেশ করবে। ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার সময় নেই। গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা প্রেসক্লাবের দিকে ছুটলাম। প্রেসক্লাবের সামনে ব্যানার নিয়ে শ দুয়েক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষ বিষণ্ন-বিষাদ চিত্তে দাঁড়িয়ে। আগুনে পোড়া মন্দির-ঘরবাড়ি, খণ্ডিত বুদ্ধমূর্তির ছবি দিয়ে ব্যানার তৈরি। 
আমরা যারা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নই—তারা লজ্জায়, ঘৃণায় মাথা অবনত করে আমাদের সহমর্মিতার কথা বললাম। বললাম, আমরা ১৫ কোটি মানুষ আপনাদের সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আমরা সবাই জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে এ দেশের নাগরিক। এ পশুশক্তিকে আমরা রুখবই। কক্সবাজার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নজীব, তাপস, দুলালের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুরো পরিস্থিতি জেনে ১ অক্টোবর জোটের জরুরি সভা আহ্বান করা হলো। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রামেন্দু মজুমদার, গোলাম কুদ্দুস, হাসান আরিফসহ একটি দল ৫ সেপ্টেম্বর কিছু অর্থ এবং নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে রামু-উখিয়া যায়। আমার কলকাতায় নাটকের পূর্বনির্ধারিত প্রদর্শনী থাকায় যেতে পারলাম না। কলকাতা থেকে ফিরে এসে ১২ সেপ্টেম্বর আমিও রামু এবং উখিয়া গমন করি।
আমাদের রামু-উখিয়া গমনে অসহায় বৌদ্ধদের মাঝে কিছুটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হলেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে আমরা পরাজিত হয়েছি। ওই অঞ্চলের অগ্নিদগ্ধ বৌদ্ধবিহার, বুদ্ধের ভগ্নমূর্তি, জ্বলে ছাই হয়ে যাওয়া বাড়িঘর, আসবাব, কাপড়, খাদ্যদানা আমাদের মানসপটে পরাজিতের চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। 
পঁচাত্তর-পরবর্তী সেনাশাসন, রাজনৈতিক মেরুকরণ, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির উত্থান এবং দেশ শাসনে অংশগ্রহণ, সংবিধানের মূলনীতিসমূহের নির্বাসন—এসব প্রগতিবিরোধী কর্মকাণ্ড দেশ ও সমাজকে এক জটিল সংকটে ঠেলে দিয়েছে। তারই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
রামু-উখিয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষকরণে যে ব্যর্থতাগুলো আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে সেগুলো হলো: ১. রাজনৈতিক ব্যর্থতা ২. প্রশাসনিক ব্যর্থতা, ৩. সামাজিক ব্যর্থতা ও ৪. সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা।
আমাদের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের নেতারা এই দাঙ্গার জন্য একে অপরকে দোষারোপ শুরু করেন। কজন অতি উৎসাহী রাজনীতিবিদ ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারের আশঙ্কা দেখতে পান। নেমে পড়েন সত্য-মিথ্যার মিশেলে নতুন গল্প নির্মাণে। দুই দলের দোষারোপের খেলা সত্য থেকে জনগণের দৃষ্টি এবং অবস্থান ভিন্ন নিষ্ক্রিয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
কক্সবাজার জেলার সামাজিক শক্তি, সাংস্কৃতিক শক্তি, পেশাজীবী ব্যক্তি ও সংগঠন, বিশেষ করে আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং খুদে দোকানদারদের তৎপরতায় প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হয়। পরবর্তী সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী নেতৃত্বের সম্প্রতি সফর আহত বৌদ্ধ জনপদের অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি ঘটে। কিন্তু অনাস্থা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা এখনো রাখা যায়নি। যদিও চেষ্টা চলছে। 
রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রামুর ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং আমাদের গভীর অনুধাবন এ সত্য আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছি।
একটি বানানো ছবি ফেসবুকে দেখে তার সত্যমিথ্যা বিচার না করে ‘ধর্ম অবমাননা’র মিছিলে স্লোগান দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির পরিকল্পিত ফাঁদে পা দেওয়া নিশ্চিতভাবে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা এবং ব্যর্থতা। যখন বোধোদয় হয়েছে, তখন তো ধর্ম অবমাননার সাধারণ সমাবেশ জামায়াত-শিবির সাম্প্রদায়িক শক্তির নেতৃত্বে পরিণত হয়েছে উন্মত্ত পশুশক্তিতে। 
প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। জেলা, উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য। কেননা পুরো ঘটনায় প্রশাসন শুধু নির্লিপ্ত নয়, অনেকাংশে উৎসাহ জোগানোর অভিযোগ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা করেছেন। দীর্ঘ সামরিক শাসন এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না এসব শক্তির রাষ্ট্র পরিচালনাকালে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি প্রশাসনে ঢুকে পড়ে এবং উচ্চপদে আসীন হয়ে তারা বাংলার হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনার নীলনকশা বাস্তবায়নে সচেষ্ট।
সামাজিক এ ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। সামাজিক বন্ধন ছিন্নপ্রায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে সমাজটাকে সংগঠিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। রামু-উখিয়ার ঘটনায় জড়িত লুটেরা এবং মন্দিরে অগ্নিসংযোগকারী বেশির ভাগ মানুষই যুবক বা তরুণ বয়সের। এবং তাদের সিংহভাগ মাদ্রাসার ছাত্র। মৌলবাদী রাজনৈতিক সামাজিক শক্তি এই মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এবং অন্যান্য অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়ে এত বড় একটি ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো হোক জ্ঞান অর্জনের স্থান, ধর্ম পালনের স্থান, ক্রীড়া অনুষ্ঠানের স্থান, মতবিনিময়ের পরিসর। এসব কিছুকে পুনর্গঠিত না করলে ভবিষ্যতে এর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে।
ধর্ম সংস্কৃতির একটি প্রাচীন অনুষঙ্গ, এটা অনস্বীকার্য। কিন্তু যদি এক ধর্মের অনুসারীরা অন্য ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় ভাব, আবেগ ও রিচ্যুয়ালসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় করেন, তবে এক সংকর সংস্কৃতি যা একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ রূপ লাভ করে। আমাদের ইতিহাস এ কথাই প্রমাণ করে হাজার বছর ধরে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন এবং আমাদের পঁচাত্তর-পরবর্তী অপশাসন এই মিথস্ক্রিয়া থেকে আমাদের জনগণকে বিরত রেখেছে। তাতে করে সাংস্কৃতিক অবিশ্বাস এবং সংঘর্ষের আশঙ্কা সদা বিরাজমান এ সমাজে। আর তারই বহিঃপ্রকাশ ২৯-৩০ সেপ্টেম্বরের ঘটনা।
১২ অক্টোবর উখিয়ার পাতাবাড়ী কেন্দ্রীয় বিহারের অত্র অঞ্চলের ৩৪টি বৌদ্ধবিহারের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে সংঘটিত ঘটনা পর্যালোচনা এবং করণীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আমার সৌভাগ্য যে আমাকে এবং আমার সঙ্গী কক্সবাজার জোটের নজীব, তাপস, দুলাল, মুজিব সবাইকে তাঁরা সে সমাবেশে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানান। আমি দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা শুনি। তাঁরা সবাই একবাক্যে বললেন, উখিয়ার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব এবং সংগঠন উখিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখতে সবিশেষ ভূমিকা রেখেছে। দাঙ্গাকারীদের বিতাড়নসহ কয়েক রাত ধরে পালা করে এখানকার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধরা সম্মিলিতভাবে মন্দির পাহারা দিয়েছেন। যার জন্য মাত্র আকস্মিক আক্রমণে দুটি মন্দির পোড়ানো এবং তিনটি ভাঙচুর হয়। এর পরপরই প্রগতিশীল মানুষ রুখে দাঁড়ান। ৩০টি মন্দির রক্ষা পায়। সবার সম্মিলিত প্রতিরোধের শক্তি আমাদের সবাইকে আশান্বিত করে। উজ্জীবিত করে।
১৩ সেপ্টেম্বর যেদিন আমি কক্সবাজার থেকে চলে আসি, সেদিন থেকে আজ অবধি বারবার আমার দেখা অগ্নিদগ্ধ মন্দির, বিহারে রক্ষিত পুড়ে যাওয়া শত শত বছরের ঐতিহ্য পুঁথি এবং বুদ্ধের মূর্তি, পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ির দোমড়ানো টিন, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, বইপুস্তক, শস্যদানা ঘুরেফিরে এসে দাঁড়ায় আমারই চোখের কোলে। এ ছবি মুছবার নয়। 
ক্ষতবিক্ষত নিষ্পাপ বুদ্ধের মুণ্ডুহীন মূর্তি। বুদ্ধ নিজের কোলে দুই হাতে ধরে রেখেছেন তাঁর নিজের মুণ্ডু। চোখ উপড়ানো, থেঁতলানো নাক কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসি অম্লান। যেন বা বলছেন—হে মানব সন্তান, তুমি তো আমাকে হত্যা করতে পারোনি। হত্যা করেছ নিজেকে। রক্তাক্ত হয়েছ নিজে। আমি তো অনাদিকাল এইভাবে তোমাদের মঙ্গল কামনায় শান্ত-সমাহিত বসে থাকব। বলব—তোমরা শান্ত হও। শান্ত হও। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
 নাসির উদ্দীন ইউসুফ: নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

No comments:

Post a Comment