Thursday, November 1, 2012

এক মাস পরে রামুতে


আবুল মোমেন | তারিখ: ০১-১১-২০১

রামুতে অনাড়ম্বর আয়োজনে এবার পালিত হলো প্রবারণা পূর্ণিমা
রামুতে অনাড়ম্বর আয়োজনে এবার পালিত হলো প্রবারণা পূর্ণিমা
২৯ অক্টোবর—ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ঠিক এক মাসের মাথায় আমরা কয়েকজন পৌঁছাই রামু। এদিন প্রবারণা পূর্ণিমা—তিন মাসের বর্ষাবাস শেষে ভিক্ষুরা এবার প্রব্রজ্যায় বেরোবেন। তাই বৌদ্ধ জনগণ মন্দিরে প্রার্থনা করবেন, দেশনা শুনবেন এবং শেষে ফানুস উড়িয়ে আনন্দ করবেন। এরপর এক মাস ধরে চলবে শ্রমণদের পোশাক বা কঠিন চীবর দানের আনুষ্ঠানিকতা। 
গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত তাদের ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি মন্দির পোড়ানো, ভাঙচুর ও লুণ্ঠিত হলে সমগ্র বৌদ্ধসমাজ প্রথমে ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিত হয়েছে। কিন্তু সাদা চোখেই যখন তারা দেখতে পায়, এতে পূর্বপ্রস্তুতির ব্যাপার ছিল এবং স্থানীয় পুলিশকর্তা ও সামগ্রিকভাবে জেলা প্রশাসনের ঔদাসীন্য/শৈথিল্য/প্রশ্রয় ছিল, তখন তো তাদের পক্ষে একে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মনে একদিকে ভয়, শঙ্কা ও ক্ষোভ কাজ করেছে, আর অন্যদিকে তাদের ভবিষ্যৎ, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভূমিকা এবং প্রশাসন সম্পর্কে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে দেশের নাগরিক সমাজের নানা পর্যায়ের মাথা মাথা ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো ঘুরে গেছেন, দেখে গেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন, ঘটনার জন্য ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তবে বড় দুই দলের নেতৃত্ব নিজেদের দুর্বলতা-দোষ ঢাকার চেষ্টা ও অন্যের গায়ে দোষ চাপানোর কৌশল চালিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে যুগপৎ হতাশ করেছেন এবং তাদের ক্ষোভ, আস্থাহীনতা ও দুর্ভাবনা বাড়িয়েছেন। 
দুই দলের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে বিএনপির ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতি এবং বর্তমানে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া থাকার কারণে দেশের অমুসলিম সম্প্রদায়ের মনে এ দল সম্পর্কে সংশয় থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। বিপরীতে আওয়ামী লীগ সহজাতভাবেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ঘটে যাওয়া অনভিপ্রেত ঘটনার ব্যাপ্তি, গভীরতা ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে যে ধরনের ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল, তা তারা নিতে পারেনি। 
গোড়া থেকেই দোষ ঢাকা ও দোষ দেওয়ার বাজে কৌশলের খেলায় মেতে অপেক্ষাকৃত সহজ কাজকে কঠিন করে ফেলা হয়েছে। সরকার সবটা জোর দিচ্ছে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করে তোলার দিকে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, দলীয় নেতারা এলাকা ঘুরেছেন, নিরাপত্তা বাড়িয়েছেন এবং বৌদ্ধ নেতাদের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক করে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের পুনর্নির্মাণ ও প্রবারণাসহ সব উৎসব-অনুষ্ঠান যেন চিরাচরিত নিয়মেই হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তবু সব রকম প্রতিকারে বা নিরাময়ে কিছু সময় লাগেই, চাপাচাপি চালিয়ে বা তাড়াহুড়া করে এসব ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া কঠিন। 
আমরা গিয়ে দেখলাম রামুর পরিবেশ থমথমে, এক মাস পরেও। পুড়ে যাওয়া, ধ্বংসপ্রাপ্ত, লুণ্ঠিত মন্দিরের যেটুকু আছে, তাতেই পুণ্যার্থী বৌদ্ধ নারী-পুরুষ-শিশুর ভিড় বাড়ছে, পূজা চলছে, দেশনা শুরু হচ্ছে। এর আগে বিকেলে বৌদ্ধরা সমবেত হয়ে এলাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম মৌন মিছিল করেছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, নিকটবর্তী প্রায় ১৫টি গ্রাম থেকে ছয়-সাত হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে এতে যোগ দিয়েছেন। উৎসবের দিনে কালো ব্যাজ পরে মৌন মিছিল করার অর্থই হলো, তাঁরা আনন্দ বাদ দিয়ে বেদনা ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। খোঁজখবর নিয়ে এর তাৎক্ষণিক কয়েকটি কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না— 
এক. নিজেদের ও মানুষের মনের অবস্থা জেনে স্থানীয় ভান্তে ও বৌদ্ধ নেতারা বুঝেছিলেন, এবারে অন্তত রামুতে প্রবারণায় ঐতিহ্যগতভাবে আনন্দ-উৎসব করা যাবে না। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন—বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকারি নির্দেশে বারবার তাঁদের চাপ দিচ্ছিল ফানুস ওড়ানোসহ প্রবারণার সব আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য। ভুক্তভোগী মানুষের মনের অবস্থা বোঝার এবং তা বিবেচনায় নেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে উদাসীন থেকে যান্ত্রিকভাবে স্বাভাবিকতা ফেরানোর এই জবরদস্তি স্বভাবতই মানুষের মনের গভীরে সৃষ্ট ক্ষত, শঙ্কা ও হতাশার কোনো উপশম করতে পারে না। 
দুই. জেলার পুলিশকর্তা মহোদয় দুর্ঘটনার রাতের নিশ্চেষ্টতা ও ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ঈদুল আজহার শুভেচ্ছাস্বরূপ মন্দিরের ভান্তেদের জন্য মাংস-পরোটাসহ যে আহার্য পাঠিয়েছেন, তাতে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের মানুষের অন্য ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীর সম্পর্কে অজ্ঞতা, সংবেদনশীলতার অভাব এবং যেনতেনভাবে ক্ষমতার দায় মেটানোর চেষ্টারই প্রকাশ ঘটে। সরকারি নির্দেশে, না নিজ বুদ্ধিতে তিনি এ কাজ করেছেন, তা বোঝা মুশকিল। 
তিন. অগ্নিকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ফলে দেশের যে মূল্যবান প্রত্নসম্পদের ক্ষতি হয়েছে, সে সম্পর্কেও কর্তৃপক্ষীয় মহলে যথাযথ সচেতনতার ও সংবেদনার অভাব বোঝা যায়, যখন দেখি এসব বিষয় নিয়ে বৌদ্ধ নেতা ও দেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অনুপুঙ্খ আলোচনার আগেই সামরিক বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় দ্রুততার সঙ্গে স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু করা হচ্ছে।
কিন্তু কথা হলো, ফাটলটা কে ভরাবে? কীভাবে ভরাবে? ফাটল যে গভীর হয়েছে তা বোঝা যায় নানাভাবে। 
এক. বৌদ্ধরা প্রবারণার দিনে প্রথার বাইরে গিয়ে কালো ব্যাজ ধারণ করে মৌন মিছিল করেছেন, তাতে ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন এবং তাকে একান্তভাবে সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন। এমনকি অন্য ধর্মাবলম্বী পরীক্ষিত বন্ধুদেরও অনুরোধ করেছেন এটিতে যোগ না দিয়ে একে তাঁদেরই বেদনা ও ক্ষোভ প্রকাশে সীমাবদ্ধ রাখায় সহযোগিতা দিতে। 
দুই. চৌমুহনীর মোড়ে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ব্যানারে যে সম্প্রীতি সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছে, তাকে মনে হচ্ছিল একটি বিচ্ছিন্ন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। রামুতে সামনের কদিনে আরও কয়েকটি সম্প্রীতি সমাবেশ যে হবে, তা জানতে পারি দোকানে নতুন নতুন ব্যানারের অসমাপ্ত লেখা পড়ে। কিন্তু সেসব আনুষ্ঠানিকতা স্বেচ্ছাসেবক লীগের চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় আছে। 
তিন. বৌদ্ধ সম্প্রদায় সন্ধ্যা সাতটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যে গণমোমবাতি প্রজ্বালনের অনুষ্ঠান ঘোষণা করেছিল, তা স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হয়। তারা নিশ্চয় নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিত ছিল। 
চার. জাতীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উদ্যোগ যে নাগরিক সমাবেশ, ঘোষণা পাঠ ও মোমবাতি প্রজ্বালনের কর্মসূচি নিয়েছিল, যাতে অংশ নিতে আমি গিয়েছিলাম, তা উন্মুক্ত স্থানের পরিবর্তে প্রাচীর ঘেরা স্কুল প্রাঙ্গণে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও ক্ষুদ্র পরিসরে সারতে হয়েছে। বৌদ্ধসহ সব ধর্মের মানুষ এতে যোগ দিলেও বৌদ্ধদের অনুরোধে রামুতে আমরা গান বাদ দিয়েছিলাম। মানুষের মনে যখন আঘাত লাগে, সে মনে নানান মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। তাতে ভয়, শঙ্কা, ক্ষোভ, ক্রোধ, হতাশার মতো অনেক নেতিবাচক ভাব সক্রিয় হয় এবং বৃহত্তর সমাজ ও সরকারের কাছ থেকে সঠিক আচরণ ও প্রতিকার না পেলে তা বাড়ে, পুঞ্জীভূত হয়। 
এ দেশে সেই ১৯৪৬, ১৯৫০ ও ১৯৬৪-এর পরে ঠিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। তবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত রাষ্ট্র চলেছে সাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে। এর দ্বারা প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দুসমাজ, তবে তুলনায় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বৌদ্ধ ও খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ও সংখ্যাগুরু মুসলমানের সমান আচরণ রাষ্ট্রের কাছে পায়নি। দীর্ঘকাল ধরে এটা চললেও এবং এর ফলে সংখ্যালঘুর সম্পত্তিহানি ও দেশত্যাগের ঘটনা ঘটলেও মুসলিম সমাজ—রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে—সামাজিক পর্যায়ে এ নিয়ে ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি, তাদের সমব্যথী হয়নি, প্রতিকারের কোনো চেষ্টা করেনি। ফলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের জন্ম হয়েছে, সংখ্যালঘুদের মধ্যে ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক আচার-অনুষ্ঠান বেড়েছে, ভেতরে ভেতরে মুসলমানদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। আমাদের রাজনীতি এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে, সংস্কৃতির সার্থকতা অতি সীমিত এবং সংখ্যাগুরুর সঙ্গে অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের দূরত্ব কেবল বাড়ছে।
সরকারি কাজের কিছু সমালোচনা করছি বটে, কিন্তু এ কাজ শুরু করতে ও চালাতে হবে সমাজকেই। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর সমাজ বিশেষভাবে সচেষ্ট হলে সর্বধর্মের মানুষের সমন্বয়ে সমাজ পরস্পরকে জানা-বোঝার, পরস্পরের কাছে আসার কাজ করতে পারে। নাগরিক সমাজ থেকে উদ্যোগ শুরু হলে তার প্রভাব পড়বে রাজনৈতিক দলের ওপর, চাপ তৈরি হবে সরকারের ওপর। তখনই শুভ শক্তির জাগরণ হবে আর অশুভ বাতাসের বিকার ক্রমে বন্ধ হতে থাকবে।
আমি শেষ করব নাগরিক সমাজের কাছে চারটি প্রস্তাব রেখে—
১. একটি জাতীয় সম্প্রীতি দিবস ঘোষণা করে সারা দেশে সব ধর্মের সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে দিনটি উদ্যাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
২. প্রত্নবিদ, ইতিহাসবিদ, বৌদ্ধ পণ্ডিত, স্থপতি, পুরকৌশলী, মানবাধিকারকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীসহ একটি বিশেষ দল গঠন করে তাদের রামুতে কিছুদিন (অন্তত ১৫ দিন) অবস্থান এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিলে দায়িত্ব পালন। সরকারের সঙ্গে এ কাজ নিয়ে যোগাযোগ থাকবে। 
৩. সরকারের উচিত হবে উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতির নেতৃত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত কমিশন গঠন। এর মূল উদ্দেশ্য হবে মূল অপরাধী, যারা এ কাজ পরিকল্পনা করেছে, এতে ইন্ধন ও সহযোগিতা দিয়েছে এবং ধ্বংসাত্মক কাজে অংশ নিয়েছে, তাদের শনাক্ত করা। পাশাপাশি এদের বাইরে যারা ঘটনার স্রোতে ভেসে তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় এবং পুলিশ প্রশাসনের নিশ্চেষ্টতার সুযোগ নিয়ে এতে অংশ নিয়েছে, তাদের আলাদা করা। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্নসম্পদ সম্পর্কে একটা অনুসন্ধান চালিয়ে ক্ষতিপূরণের নির্দেশনাও এ কমিশন দেবে। 
৪. মিয়ানমারে চলমান এবং নতুনভাবে ঘটমান রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নৃশংস নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে হবে। পাশাপাশি এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে মানবিক ত্রাণ নিয়ে দাঁড়াতে হবে এবং সরকারকে চাপ দিতে হবে যাতে তাদের যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে মিয়ানমার সরকার এ সমস্যার স্থায়ী মানবিক সমাধানে বাধ্য হয়। 
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

রোহিঙ্গা সমস্যা: তিলের ভেতর লুকানো তাল

ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ০১-১১-২০১২

রোহিঙ্গাদের অমানবিক দুর্দশা অচিরেই নিরাপত্তা সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে
রোহিঙ্গাদের অমানবিক দুর্দশা অচিরেই নিরাপত্তা সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে ‘রোহিঙ্গা সমস্যা মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যকার ধর্মীয় সংঘাত নয়, এটা হলো নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিষয়। আমাদের খুবই হুঁশিয়ার থাকতে হবে।’ 
—সুরিন পিতসুয়ান, আসিয়ান জোটের সেক্রেটারি জেনারেল 

বিশ্বব্যাপীই সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংঘাতের ঢল দেখা যাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের বলকান যুদ্ধ থেকে যাত্রা করে ভূমধ্যসাগর তীরের আরব অঞ্চল হয়ে সেই সংঘাত ইউরোপ-আমেরিকায়ও চাঙা হচ্ছে। হিংসার ঢল হালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও পৌঁছেছে। গত জুনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী সাম্প্রদায়িকতায় অনেক প্রাণ গেছে, উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। তারপর আসামে বাঙালি মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা এল। এরপর রামুতে হলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মস্থানে বর্বর আক্রমণ। এরপর আবারও শিকার হচ্ছে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানেরা। সব কটি ঘটনাতেই কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমস্যাটা তাই নিছক সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা নয়, ইতিমধ্যে এটা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট আসিয়ান-প্রধানও সেদিকেই নজর কেড়েছেন।
গত ৩০ অক্টোবর আসিয়ানের সেক্রেটারি জেনারেল সুরিন পিতসুয়ান হুঁশিয়ারি করেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর চলছে অসহনীয় চাপ, যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ। আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই চাপ ও যন্ত্রণা দূর করতে না পারলে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা চরম পন্থার দিকে যাবে। তা হলে মালাক্কা প্রণালি থেকে শুরু করে সমগ্র অঞ্চলটিই অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।’ ইতিমধ্যে ব্রিটেনের অর্থপুষ্ট মুসলিম এইড এবং সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত এনজিওগুলো রোহিঙ্গা কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োজিত। অন্যদিকে সৌদি আরবের মদদে বিক্ষুব্ধ রোহিঙ্গাদের একটি অংশ জঙ্গি প্রশিক্ষণ পাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। 
মালাক্কা প্রণালি দুনিয়ার বাণিজ্যিক চলাচলের উল্লেখযোগ্য অংশ। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগ হলো এই প্রণালি। ভারত, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বাঘা বাঘা অর্থনৈতিক শক্তি এই নৌপথের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। এই অঞ্চল ঘিরে রয়েছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ জনসংখ্যার দেশগুলো। খ্রিষ্টান ছাড়া বাকিদের প্রত্যেকেরই জনসংখ্যা শতকোটির ওপর। আবার ভারত মহাসাগরে সামরিক প্রাধান্য বজায় রাখা এবং এশীয় অঞ্চলে চীনকে হটিয়ে প্রাধান্য বিস্তার করা এখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত উদ্দেশ্য ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মসূচি। 
আসিয়ান-প্রধান আরও বলেছেন, ‘এই অঞ্চলটি সহিংসতার ঝুঁকিতে নিপতিত হলে আসিয়ান ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ক্ষতি হবে। ব্যাপারটির অনেক বৃহত্তর কৌশলগত এবং নিরাপত্তাগত পরিণাম রয়েছে।’ সুরিনের শেষ কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যকার ধর্মীয় সংঘাত নয়, এটা নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিষয়। আমাদের খুবই হুঁশিয়ার থাকতে হবে।’ (৩০ অক্টোবর, জাকার্তা পোস্ট)
দেশের ভেতরে যা সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সমস্যা, আন্তর্জাতিক স্তরে তা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত হুমকি। মিয়ানমার যে রূপান্তর পর্ব পার করছে, তা এই অঞ্চলের গণতন্ত্রায়ণ থমকে দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক সংঘাত ছড়িয়ে দিতে পারে। দেশটিতে বর্মি প্রাধান্যের বিরুদ্ধে কারেন, কাচিং, মং, চীন, রাখাইনসহ অজস্র জাতিগোষ্ঠীর দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াই চলছে। সরকারিভাবে ১৩৫টি স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বর্মিরা একাই ৫০ শতাংশ। অথচ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সম্পদের ৮০-৯০ ভাগের মালিক তারা। এই জাতীয়তাবাদের প্রধান হাতিয়ার হলো থেরাভাদা বৌদ্ধবাদ। দেশটির খ্রিষ্টান, মুসলিম, প্রাণীপূজক ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের অসীম বিদ্বেষ। সু চি নিজেও থেরাভাদা বৌদ্ধবাদী বর্মি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত বই বার্মা অ্যান্ড ইন্ডিয়ায় তিনি লিখেছেন, ‘বৌদ্ধবাদ হলো শ্রেষ্ঠ দর্শন...সুতরাং এর কোনো সংস্কার যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি দরকার নেই অন্য কোনো দর্শনকে বিবেচনায় আনা।’ এককথায়, এটাই মিয়ানমারের অধিপতি বর্মি শাসকদের রাজনৈদিক মতাদর্শ। অধিকাংশ বর্মি এর অনুসারী। 
২০০৭ সালের গেরুয়া বিপ্লবে সু চির পক্ষে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিপুলভাবে রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। গণতন্ত্রপন্থী সেই ধর্মীয় বিক্ষোভ থেকেই সন্ন্যাসীরা বর্মিদের আপন ও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠেন। তাঁরা হয়ে ওঠেন একই সঙ্গে সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা। সু চির বর্তমান জনপ্রিয়তা ও জনভিত্তির খুঁটিও এই সন্ন্যাসীরা। চার মাস ধরে চলা রোহিঙ্গা নির্মূলকরণ অভিযানের নায়কেরাও মোটামুটি সু চি-সমর্থক গণতন্ত্রপন্থী। অথচ ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও চারজন রোহিঙ্গা সে দেশের এমপি হয়েছিলেন।
গত জুলাইয়ে সিত্তে শহরে দাঙ্গার শুরু করেছিলেন সু চির দলের এক এমপি। এবারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন গেরুয়া বিপ্লবের নেতারা। এঁদের অন্যতম হলেন সন্ন্যাসী বিরাথু। ২০০৩ সালে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা উসকানোর অভিযোগে ২৫ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর। পরে রাজনৈতিক বন্দীদের মুত্তির প্রক্রিয়ায় তিনিও ছাড়া পান। তিনি এখন যুব সন্ন্যাসী সমিতির প্রধান। এই সংগঠন অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে একযোগে রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারাভিযান চালাচ্ছে, বাধা দিচ্ছে উদ্বাস্তুদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর কাজে। আরেক সন্ন্যাসী নেতা আসিন হতাওয়ারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠাতে বদ্ধপরিকর। সু চি তাঁর ‘বিশেষ প্রিয় নেতা’। তিনি চান, রোহিঙ্গাদের নাৎসি জার্মানির ইহুদিদের মতো করে শ্রমশিবিরে রাখা হোক। উগ্র বৌদ্ধপন্থী বর্মি জাতীয়তাবাদ নিজেদের হিটলারি জার্মানির আর্যগর্বের মতো বিশুদ্ধ বর্মি জাতির স্বপ্ন দেখায়, যেখানে অবর্মি ও অবৌদ্ধরা হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এই জাতীয়তাবাদীরা এর আগে মিয়ানমারের চীনা বৌদ্ধদের ওপর বিরাট গণহত্যা চালিয়েছিল। ভোট হারানোর ভয়ে 
সু চিও নীরব। সু চি ও সামরিক জান্তা উভয়ই জাতিগত বিদ্রোহ থেকে দৃষ্টি সরানোয় রোহিঙ্গা কার্ড খেলে চলেছেন। রাখাইন প্রদেশের আরাকান লিবারেশন আর্মিও মনে করে, বর্মিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আগে রোহিঙ্গা বিতাড়নে সরকারকে সহযোগিতা দেওয়া লাভজনক।
মিয়ানমারের নব্য জাগরিত পুরোহিততন্ত্র পাশে পাচ্ছে রাষ্ট্রপ্রশাসন, গণমাধ্যম এবং ব্যবসায়ী শ্রেণীকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তহবিলপুষ্ট ন্যাশনাল এনডৌমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি এবং কুখ্যাত মার্কিন ধনকুবের জর্জ সরোসের ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটিউট এদের প্রধান আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক। এরাই মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে গণতন্ত্রপন্থীদের প্রশিক্ষণ ও তহবিল দিয়ে আসছে। ব্রিটেনের বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকেও একইভাবে সু চির অনুসারীদের শক্তিশালী করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ইস্ট এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের প্রতিবেদন খোলাখুলি জানাচ্ছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের জন্য কাজ করে যাওয়ায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক কর্মীদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাবে।’ 
সুতরাং বর্মি ও রাখাইন উগ্র সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ আর গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতিশোধস্পৃহার ক্রসফায়ারে বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি যাওয়ার হুমকিতে। 

দুই.
বুঝতে অসুবিধা হয় না, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী সু চি সামরিক জান্তার সরকারের সঙ্গে কেনই বা সহযোগিতা করছেন আর কেনই বা মিয়ানমারের অঢেল খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগের পক্ষে ওকালতিতে নেমেছেন। গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী একই সঙ্গে মিয়ানমার থেকে চীনের প্রভাব ও বিনিয়োগ দুই-ই কমিয়ে ফেলতে চান। খেয়াল করার বিষয়, মিয়ানমারের যে দুটি প্রদেশে এখন জাতিগত সহিংসতা চলছে, দুটিতেই চীনের বিরাট বিনিয়োগ রয়েছে। একটি হচ্ছে, কারেন প্রদেশ, সেখানে চীনা বিনিয়োগে নির্মিত বিরাট এক পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এই প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎ চীনের কিছু অঞ্চলের জ্বালানি ঘাটতি মেটানোয় অপরিহার্য ছিল। রাখাইন প্রদেশের প্রলম্বিত অশান্তিতে এসবই ভেস্তে যাওয়ার মুখে। 
রাখাইন প্রদেশসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর এলাকা কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ। চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত। এই রাখাইন উপকূল থেকেই গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের ইউনান প্রদেশে যাওয়ার কথা। চীনের জন্য বঙ্গোপসাগরে বের হওয়ার কৌশলগত পথও এটি। রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তে শহরে চীনা তহবিলে বন্দর নির্মাণও চলছে। সম্প্রতি ধ্বংস হওয়া রোহিঙ্গা বসতিও এর কাছেই ছিল। এর উল্টো দিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা প্রসারিত হওয়াজনিত জটিলতাও এই পটভূমির অংশ। 
সুতরাং, রাখাইন প্রদেশ থেকে রামু পর্যন্ত জাতিগত দ্বন্দ্ব উসকে ওঠাকে কেবল সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সমস্যা হিসেবে ভাবার সুযোগ নেই। আসিয়ান-প্রধানও সেই ইঙ্গিতই করেছেন। বিশ্বের দিকে তাকালেও দেখা যায়, জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল অথবা তেল-গ্যাসের আন্তর্জাতিক পাইপলাইনের আশপাশজুড়েই অন্তহীন সহিংসতা চালু আছে। চালু আছে যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, সামাজিক অসন্তোষ এবং ন্যাটোর সামরিকায়ন। পশ্চিমা সরকার, মানবাধিকার সংস্থা, এনজিওগুলো সেই অঞ্চলেই গণতন্ত্র রপ্তানির জন্য ব্যতিব্যস্ত, যেখানে তাদের মালিকানার দানবীয় জ্বালানি কোম্পানিগুলো খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পেতে মরিয়া। জাতি-সম্প্রদায়-পরিবার ও দেশ তাদের চোখে দাবার ঘুঁটি মাত্র। রোহিঙ্গা বনাম রাখাইন দ্বন্দ্বে তাই বাংলাদেশকে যেমন মানবিক হতে হবে, তেমনি হতে হবে দীর্ঘমেয়াদিভাবে কৌশলী।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments:

Post a Comment