Wednesday, November 14, 2012

ইতিহাস - চট্টগ্রাম-আরাকান অঞ্চল কি আসলেই মগের মুল্লুক?


প্রশান্ত ত্রিপুরা | তারিখ: ১৪-১১-২০১২
চট্টগ্রাম ও আরাকান, ভূগোলের হিসাবে পড়শি এবং ইতিহাসের বিচারে সহোদর, এই দুটি অঞ্চলে বহুকাল ধরে বিরাজ করছে অস্থিরতা (এখানে চট্টগ্রাম বলতে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ফেনী নদীর পাড় থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ভূখণ্ডকে বোঝানো হয়েছে)। কয়েক দশক ধরে নাফ নদীর উভয় পারেই চলছে হানাহানি। ‘শান্তিচুক্তি’র ১৫ বছর পরও পার্বত্য ভূমিতে চলছে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দৌরাত্ম্য, যা বড় আকারে সর্বশেষ নজরে এসেছিল ২২ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার ঘটনায়। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই রামুতে ঘটল বৌদ্ধদের ওপর নজিরবিহীন হামলা, যে অরাজকতার ঢেউ উখিয়া ও পটিয়াতেও আছড়ে পড়েছিল। সেই ঘটনার জের ধরে এখনো চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ ও জল্পনা-কল্পনা। ঘটনার পর পরই দেখা গেছে পারস্পরিক দোষারোপের খেলা। এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দিকে আঙুল তুলেছে অনেকে। অনেকে এটা বোঝাতে চেয়েছে যে আরাকানে মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধদের নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এ দেশে বৌদ্ধদের ওপর হামলা হয়েছে। যেন-বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এই তত্ত্বকে প্রমাণ করার জন্যই রামুর ঘটনার পর এক মাস না যেতেই আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে হামলা শুরু হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আরাকানে দীর্ঘদিন ধরে যে অচলাবস্থা চলছে, বা সম্প্রতি রাঙামাটি, রামু, উখিয়া, পটিয়া ও আরাকানের নাফ সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটেছে, এগুলোর মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক নেই? ভূগোল, ইতিহাস, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে এ প্রশ্নের উত্তরে অবশ্যই ‘আছে’ বলতে হয়। এ বিষয়ে আলোচনার একটা বিশেষ প্রবণতা হলো, আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে ব্যাখ্যায় সাম্প্রদায়িকতা, অজ্ঞতা, তথ্যের অপব্যাখ্যা বা মিথ্যাচারের উপস্থিতি। যেমন—কেউ কেউ বলছেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকানে যে বর্ণবাদী আচরণ করা হচ্ছে, তার শিকড় গাঁথা আছে সেখানকার অতীত ইতিহাসে, যা দস্যুতা ও হিংস্রতায় ভরা। অর্থাৎ আরাকান আসলেই ছিল ‘মগের মুল্লুক’, অরাজক দেশ। কবেকার কোন ‘মগ’ রাজা নাকি আরাকানে আশ্রয় নেওয়া মোগল শাহজাদা সুজাকে পুরো পরিবারসহ হত্যা করেছিলেন, সে প্রসঙ্গ টেনে এনে (তবে সুজা যে নিজ ভাইয়ের হাত থেকে জানে বাঁচতে আরাকানে গিয়েছিলেন, সেটা ঊহ্য রেখে) প্রকারান্তরে বোঝানো হয়েছে যে আরাকানের সমকালীন বৌদ্ধ ‘রাখাইন’রা সেই ‘মগ’ রাজারই উত্তরসূরি। মগ আর রাখাইন শব্দ দুটি সমার্থকভাবেই ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্ণবাদী বৈষম্যের ইতিহাস উন্মোচনের নামে পুরো রাখাইন জাতিকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলে। এটাও দাবি করা হয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ‘অবাঙালি উপজাতি’ সবাই রোহিঙ্গাদের মতোই আরাকান থেকে আসা ‘অভিবাসী’। পক্ষান্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা নাকি বসবাস করে আসছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। অর্থাৎ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এটাই বলা হচ্ছে যে ‘বাঙালিরাই বাংলাদেশের সত্যিকারের আদিবাসী’। প্রচ্ছন্ন বক্তব্যটা বুঝি-বা এই, বাইরে থেকে আসা মগরাই যত নষ্টের মূলে, তাদের তাড়ালে এ দেশে কোনো মগের মুল্লুক থাকবে না, এটা আবার হয়ে যাবে শুধুই বাঙালিদের দেশ।
আরাকানে বৈষম্যের শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেকে সহানুভূতি দেখালেও তারা মুসলমান, এই পরিচয়ের বাইরে তাদের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কেও এ দেশের শিক্ষিত মহলে তেমন স্বচ্ছ ধারণা নেই। বরং সমকালীন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন ভ্রান্ত ও অবমাননাকর ধারণা। আর রোহিঙ্গা পরিচয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়ে শোনা কথাকেই সত্য ধরে লেখালেখি করছেন অনেকে। যেমন—অষ্টম শতাব্দীতে জাহাজডুবির শিকার কিছু আরব নাবিকের প্রতি স্থানীয় রাজার দেখানো ‘রহম’ (করুণা) থেকে ‘রোহিঙ্গা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে, এমন কিংবদন্তিকে ইতিহাস হিসেবে উল্লিখিত হতে দেখেছি। এই কাহিনি যে সাম্প্রতিক কালে রোহিঙ্গা পরিচয়ের ইসলামীকরণের অংশ হতে পারে, তা তলিয়ে দেখা হয়নি। শোনা যায়, সংখ্যায় খুব কম হলেও রোহিঙ্গা ভাষায় কথা বলে, কিন্তু ধর্মের দিক থেকে হিন্দু বা বৌদ্ধ—এমন লোকজনও কিছু আছে আরাকানে। যদি তা-ই হয়, তাহলে রোহিঙ্গা পরিচয়কে শুধু মুসলমানদের সঙ্গে বেঁধে ফেলার ঘটনাটা কীভাবে ঘটল? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার যে বহু দশক ধরে সামরিক শাসনাধীন ছিল, বিষয়টা খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে দেখা গেছে, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের পর বৈধতার জন্য সামরিক শাসকেরা সংখ্যাগুরুদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েছেন, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েছেন। মিয়ানমারেও তেমনটিই ঘটেছে বলে মনে হয়। এই প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা, যেভাবে বাংলাদেশেও জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্রমশ তাদের পায়ের তলার মাটি হারিয়েছে, হারাচ্ছে।
বাংলাদেশে ভাষাভিত্তিক ও ধর্মাশ্রয়ী—এ দুই ঘরানার প্রবল জাতীয়তাবাদের টানাপোড়েনের মাঝখানে ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে টানাহেঁচড়া চলে আসছে বহুদিন ধরে। তবে কোনো পক্ষই এ দেশের ভূগোল, ইতিহাস, সমাজপাঠ প্রভৃতিতে প্রান্তিক জাতিগুলোকে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করেনি। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের কথা স্কুলে পড়ানো হয়, কিন্তু সে সময় চট্টগ্রাম যে আরাকানের অংশ ছিল বা সেই রাজ্যের সীমানায় যে আরও বহু ভাষা ও বহু জাতি ছিল—এসব বিষয় পড়ানো হয় না। বরং মারমা ও রাখাইন নামে পরিচিত দুটি জনগোষ্ঠীকে তাদের আপত্তি সত্ত্বেও এখনো অনেক জায়গায় উল্লেখ করা হয় ‘মগ’ হিসেবে। পাশাপাশি মগরা যে জলদস্যু ছিল, তা-ও শেখানো হয় ইতিহাসের ক্লাসে। ওদিকে বাংলা ক্লাসে বাগধারা শেখানো হয়, মগের মুল্লুক মানে হচ্ছে অরাজকতা। অনেকেই হয়তো জানেন, চট্টগ্রামের বাঙালিদের অপমান করার একটা মোক্ষম উপায় হলো তাদের মগ বলে গালি দেওয়া। তবে মগ পরিচয়টা সব সময় গালি হিসেবে ব্যবহূত হতো, তা মনে হয় না। আগে মগ বলতে আরাকানের (বা বার্মার) অধিবাসী বা সেখান থেকে আসা মানুষকে বোঝানো হতো। আর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে চট্টগ্রামে বর্তমানে যেসব বাঙালি সম্প্রদায় রয়েছে, তাদের অনেকে (যেমন-বড়ুয়ারা) একসময় আসলেই মগ নামে পরিচিত ছিল। ফ্রান্সিস বুখানন নামে একজন পর্যবেক্ষক ১৭৯৮ সালে ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল) ও চট্টগ্রাম (বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ) সফর করে যে বিশদ বিবরণ লিখে রেখে গেছেন, তাতে অন্তত সে রকমই উল্লেখ আছে।
মগ শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে যেসব ব্যাখ্যা এযাবৎ পড়েছি, আমার কাছে কোনোটাই খুব একটা নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি। আমার নিজের অনুমান হচ্ছে, বাংলা ভাষায় মগ শব্দটা গালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, হয়তোবা বুখানন যে সময় চট্টগ্রাম অঞ্চল সফর করেছিলেন, তখন বা আরও পরে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ব্রিটিশরা যখন ১৭৫৭ সালে চট্টগ্রামের দখল পায়, আরাকান ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য এবং চট্টগ্রামের ওপর দাবি আরাকানিরা তখনো পুরোপুরি ছাড়েনি। এই অবস্থায় ১৭৮৪ সালে আরাকান চলে যায় বার্মা সাম্রাজ্যের অধীনে। আরও পরে, বার্মা যখন মণিপুর ও আসাম দখল করে নেয়, ১৮২৪ সালে প্রথম ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধ হয়, যার ফলে আরাকান ও আসাম চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে এবং আরও দুটি যুদ্ধের পর ১৮৮৫ সালে পুরো বার্মা চলে আসে ব্রিটিশদের দখলে। উল্লেখ্য, বৈশ্বিক পরিসরে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় সে যুগে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ব্রিটিশদের পাশাপাশি পর্তুগিজ ও ফরাসিরাও বেশ তৎপর ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বিভিন্নমুখী আঁতাত গড়ে উঠেছিল, যেমন—আরাকানিদের সঙ্গে পর্তুগিজদের, বার্মার সঙ্গে ফরাসিদের, ব্রিটিশদের সঙ্গে শ্যাম দেশের (বর্তমান থাইল্যান্ড)। কাজেই এ উপমহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ইংরেজদের জয়লাভ আর ইতিহাসে জলদস্যু হিসেবে মগ ও পর্তুগিজদের ঠাঁই হওয়ার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতেই পারে (ইংরেজদের বদলে ফরাসি বা পর্তুগিজরা বাংলা দখল করলে আমরা হয়তো ইংরেজ ও থাই জলদস্যুদের কথাই পড়তাম ইতিহাসে)। 
পাশাপাশি যখন আমরা এটা স্মরণ করি যে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রসার ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে এবং বার্মা জয়ের পর সেই দেশ শাসনে ব্রিটিশদের অন্যতম সহযোগী ছিল নববিকশিত বাঙালি বাবু শ্রেণীর লোকজন, তাহলে এটা অনুমান করা অযৌক্তিক নয় যে আরাকানি ও বর্মিদের হিংস্র ও বর্বর হিসেবে দেখিয়ে সাম্রাজ্যের মতাদর্শিক ভিত রচনার ব্রিটিশ কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলা ভাষায়ও মগরা অরাজকতার প্রতিমূর্তি হিসেবে জায়গা করে নেয়। তা না হলে বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক থেকে মগরা যে স্রেফ দস্যুতে পরিণত হয়ে গেল, এর ব্যাখ্যা কী? ওদিকে আরও বড় দস্যু যারা ছিল, তারা এই অঞ্চলকে বিভিন্নভাবে নিঃস্ব-রিক্ত করে বুনে রেখে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার বীজ। একবিংশ শতাব্দীতেও কি একই ধরনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে না?
প্রশান্ত ত্রিপুরা: সাবেক অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment