মানসুরা হোসাইন | তারিখ: ২৪-১১-২০১২
দেশে প্রথমবারের মতো ‘বেদে, দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের জীবন উন্নয়ন কর্মসূচি’ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। অনুন্নয়ন বাজেট থেকে প্রস্তাবিত কর্মসূচিতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, বর্তমানে কর্মসূচির প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে গত জুলাই থেকে, চলবে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত। এক বছরের পরীক্ষামূলক (পাইলট) কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করবে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে দলিত, হরিজন ও বেদেদের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ। এদের মধ্যে ২১ হাজার ৩৫০ জন উপকারভোগীর জন্য কর্মসূচিটি হাতে নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় এককালীন অনুদান ছাড়াও থাকছে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া, ঋণ ও মাসিক ভাতা বিতরণ প্রভৃতি।
সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে আটটি গোত্রে বিভক্ত বেদে সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা প্রায় আট লাখ। এদের শতকরা ৯৮ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ক্ষুদ্র ব্যবসা, তাবিজ বিক্রি, সাপের কামড়ের চিকিৎসা, সাপের খেলা দেখানো, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, কবিরাজি, বানর খেলা দেখানো ও জাদু দেখানো এ সম্প্রদায়ের প্রধান পেশা।
প্রস্তাবনায় দলিত ও হরিজন জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বলা হয়েছে, এরা সমাজে নিম্ন মর্যাদার জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। এই দুই সম্প্রদায়ের ৫৫ লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে হরিজনদের সংখ্যা ১৫ লাখ, বাকি ৪০ লাখ দলিত সম্প্রদায়ের।
দলিত অর্থ নিগৃহীত বা যারা দলনের শিকার। এরা মেথর, বাঁশফোর, ডোমার, রাউত, তেলেগু, ঋষি, জেলে, সন্ন্যাসী, বেহারা, ধোপা, হাজাম, নিকারি, পাটনি, তেলী প্রভৃতি নামে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে।
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব রাজকুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষা, বাসস্থান, চাকরি পাওয়ার মতো বিষয়েও আমাদের দাবি জানাতে হয়। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতা-কর্মীর চাকরিটি টিকিয়ে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছ পর্যন্ত যেতে হয়েছে।’
হরিজনদের সার্বিক অবস্থা প্রসঙ্গে রাজকুমার আক্ষেপ করে জানান, আট বাই আট ফুট আয়তনের একটি ঘরের মধ্যে বাবা, মা, বউ, বাচ্চা, ছেলের বউসহ কয়েক প্রজন্মকে একসঙ্গে থাকতে হয়। সরকার যেখানে থাকার জায়গা দিয়েছে তা এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে সারাক্ষণ ভয়ে থাকতে হয়। তবে সরকারের কিছুটা উদ্যোগের ফলে বর্তমানে তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে।
রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান এলাকায় বেদে নারীদের হাতে থাকে ছোট একটি কাঠের বাক্স। একেকজনের সামনে গিয়ে সেই বক্স দেখিয়ে ভেতরে সাপ আছে—এমন ভয় দেখান। এটা দেখে কেউ বা ভয়ে, কেউ বা করুণা করে কিছু টাকা দেন। অনেক সময় টাকার জন্য পথরোধ করে দাঁড়ান বেদে নারীরা।
ধানমন্ডি রবীন্দ্রসরোবরে কথা হয় বেদে নারী লক্ষ্মীর সঙ্গে। তিনি প্রতিদিন সাভার থেকে আসেন। সঙ্গে একটি ছোট বাচ্চা। লক্ষ্মী জানান, পুরুষ বেদেরা সাপের খেলা দেখিয়ে বা অন্যভাবে টাকা রোজগার করেন। কিন্তু এখন আর আগের মতো কেউ সাপের খেলা দেখে না বা দেখলেও টাকা দেয় না। এ সম্প্রদায়ের নারীদের কেউ কাজ দেয় না। ফলে বাধ্য হয়েই তিনি এ পথ বেছে নিয়েছেন।
জানা যায়, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, ঝিনাইদহ, যশোর, বরিশাল, ঝালকাঠি জেলার বিভিন্ন জায়গায় বেদে সম্প্রদায়ের জন্য কর্মসূচি পরিচালনা করা হবে। দলিত ও হরিজনদের জন্য কর্মসূচি পরিচালনা করা হবে দেশব্যাপী।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে জানান, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় এনে এই সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সরকার বিশেষ নজর দিয়ে এ কর্মসূচি পরিচালনা করতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশ দলিত ফোরামের প্রধান উপদেষ্টা মেসবাহ কামাল প্রথম আলোকে জানান, অর্থনৈতিক অবস্থার চেয়েও মানুষের তৈরি বৈষম্য দলিত (বেদেসহ) সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দেরিতে হলেও সরকার গৃহীত এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
No comments:
Post a Comment