Friday, November 2, 2012

সমৃদ্ধ নগর 'অ্যাংকর'


8:35 pm BdST, Friday, Nov 2, 2012
ঋতি মৃত্তিকা নয়ন

তোমার বার্বি পুতুলটাতো তোমার কাছে খুবই প্রিয়; তুমি ওর সঙ্গে খেলো, কথা বলো, অনেকটা সময় কাটাও ওর সঙ্গে। এখন যদি পুতুলটা নষ্ট হয়ে যায়, কিংবা কেউ যদি তোমার পুতুলটা ভেঙ্গে ফেলে, তাহলে তো তোমার খুব মন খারাপ হবে, তাই না? বার্বি পুতুলটা যেমন তোমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি আমাদের আশেপাশের গাছপালা, ঘর-বাড়ি, ভাস্কর্য সবকিছুই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের সভ্যতার পুরোনো দিনের যে সব স্মৃতিময় স্থাপনাগুলো আছে, সেগুলো তো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এরকমই একটা সভ্যতার নিদর্শন হল ‘অ্যাংকর’।
খ্রীষ্টপূর্ব ৮০২ সনের দিকে, মানে খ্রীষ্টের জন্মেরও ৮০২ বছর আগের কথা। তখন কম্বুজা ছিল জাভা দ্বীপের সম্রাটের অধীনে। ভাবছো, কম্বুজা, জাভা- এগুলো আবার কোন দেশ? এখনকার কম্বোডিয়া ও তার আশেপাশের দেশগুলোকে তখন একসাথে বলা হত কম্বুজা। আর জাভা হলো ইন্দোনেশিয়ার একটি দ্বীপ। ‘জয়বর্মন’ জাভার রাজার কাছ থেকে কম্বুজাকে স্বাধীন করেন। তারপর সেখানে এক নতুন সাম্রাজ্য স্থাপন করেন, গোড়াপত্তন করেন এক নতুন নগরের- ‘অ্যাংকর’। তিনিই অ্যাংকরের প্রথম রাজা।

ভাবছো, এই অ্যাংকর আবার কেমন নাম? অ্যাংকর আসলে একটা খেমার শব্দ, মানে কম্বোডিয়ান ভাষার শব্দ। বাংলা করলে অনেকটা এরকম হয়- পবিত্র শহর।
রাজা হয়েই তিনি ‘দেবরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। তখন রাজাদের মধ্যে এরকম একটা রীতি প্রচলিত ছিল, সবাই তার ক্ষমতা ও প্রতাপ অনুযায়ী একটা করে উপাধি গ্রহণ করতেন। দেবরাজ বা জয়বর্মন প্রতিষ্ঠিত এই রাজবংশই পরে খমের বা খেমার নামে পরিচিতি পায়। নবম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দি পর্যন্ত, এই খেমাররা মায়ানমারের (তখনকার বার্মা) পশ্চিম থেকে ভিয়েতনামের পূর্বাংশ পর্যন্ত শাসন করতো। আর খেমার সাম্রাজ্যের রাজধানী-ই ছিল এই অ্যাংকর। অ্যাংকর কিন্তু একদম যা-তা শহর ছিল না; সেই সময়ের সবচেয়ে অভিজাত ও সমৃদ্ধ নগরীগুলোর একটি ছিল এই অ্যাংকর। আয়তনে নগরটি ছিল বিশাল, আর তাতে সেই সময়েই বাস করতো প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোক।

এই সমৃদ্ধ নগরীর প্রভাব-প্রতিপত্তি ঠাঁট-বাঁট বজায় ছিল বহু বছর। সবশেষে ১৪৩১ সালে অযোধ্যার রাজার কাছে পরাজিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায় অ্যাংকর নগরটি। অযোধ্যা চিনেছো তো? আজকের থাইল্যান্ডেই ছিল অযোধ্যা।

এই কম্বোডিয়ানদের পূর্বপুরুষরা, অর্থাৎ খেমাররাই ছিল পৃথিবীর বন্ধুসুলভ জাতিদের অন্যতম। আর হয়তো সে কারণেই তারা নিজেদের বিলুপ্তি সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য করতে চায়নি! অ্যাংকরের বিলুপ্ত হওয়ার কাহিনি তাই এখনো এক বিশাল রহস্যই থেকে গেছে।
খেমার রাজারা তো হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তাই তারা অনেকগুলো হিন্দু মন্দির ও অনেক সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য তৈরি করেন। এগুলোর মধ্যে একটা আবার ছিল ঠিক যেন একটা ফুটন্ত পদ্মের মতো। কী চমৎকার ছিল সেটা দেখতে, একবার ভাবো তো! এই মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত যেটা, সেটার নাম অ্যাংকর ওয়াত। মন্দিরটি বানিয়েছিলেন রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ। মন্দিরটি কিন্তু এখনো আছে।

মন্দিরগুলোর দেয়ালের গায়ে তারা খোদাই করেছিল অদ্ভুত সব মূর্তি; অধিকাংশই নৃত্যরত। এই মূর্তিগুলোও তাদের উর্বর চিন্তা ও কল্পনাশক্তির পরিচয় দেয়। তাদের ধারণা ছিল, এই মূর্তিগুলো তাদের আর তাদের দেবতাদের মাঝে সংযোগ স্থাপন করতো।

ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দির দিকে থেরাভাদা বৌদ্ধ সম্প্রদায় ধীরে ধীরে অ্যাংকরে জনসংখ্যায় বাড়তে থাকে। হিন্দুদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমতে থাকায়, অ্যাংকরের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপরও বৌদ্ধদের প্রভাব বাড়তে থাকে। তাতে অবশ্য খুব একটা সমস্যা হচ্ছিল না, কারো সাথে কারো তো কোনো শত্রুতাও ছিল না; কিন্তু গোল বাঁধলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাম্যের নীতির কারণে। জানোই তো, হিন্দু ধর্মে তো বর্ণপ্রথা আছে; হিন্দু ধর্মে চারটি বর্ণ- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেশি, তারপর ক্ষত্রিয়দের। বৈশ্যদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল আরো কম। আর শূদ্ররা ছিল একরকম অবহেলিত। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মে তো এরকম বর্ণবিভাজন নেই, সবাই-ই সমান। এ কারণে, অ্যাংকর সম্রাটদের আভিজাত্যে ভাটা পরতে থাকে। অনেক গবেষকের মতে, ধর্মীয় রীতিনীতির বদল হওয়াতেই একসময় সামাজিক ও রাজনৈতিক কলহ ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে, অ্যাংকরের সভ্যতার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মানে, অ্যাংকরের পতনের এটাও একটা কারণ ছিল।
পশ্চিমের অযোধ্যা আর পূর্বের চম্পা- এই দুই রাজ্য ছিল অ্যাংকরের শত্রæরাজ্য। সবসময়ই তারা ক্ষমতার জন্য একে অন্যের সঙ্গে লড়াই করতো। অনেকের মতে, এই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ধর্মীয় কলহই অ্যাংকরের ধ্বংসের অন্যতম কারণ। আর ষোড়শ শতকে উত্তর-পূর্ব এশিয়া ও চীনের মধ্যে একটা ‘সমুদ্র চুক্তি’ হয়। এই সমুদ্র চুক্তি এশিয়ার এই সমৃদ্ধ সভ্যতাকে আরো বেশি ভঙ্গুর করে দেয়।

অ্যাংকর নগরের সমৃদ্ধির একটা বড়ো উদাহরণ ছিল নগরটির জলব্যবস্থা। এর নালা, খাল-বিলগুলো প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছিল। এই নালা, খাল-বিলগুলোকে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা হত পানি বয়ে নিয়ে আনার জন্য, আর বর্ষার মৌসুমে ব্যবহার করা হত অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে।
তবে ক্রমেই অ্যাংকরের অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। নগরটির জলব্যবস্থাও ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে। আগে যেখানে জলজ উদ্ভিদ ছিল, পরে সেখানে এমন সব গাছপালা জন্মাতে শুরু করলো, যেগুলো পানিতে বাস করার বদলে উল্টো পানি শুষে নেয়। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় মোটামুটি ত্রয়োদশ শতকেই। সব মিলিয়ে নগরটির অবস্থা বেশ সঙ্গীন হয়ে পড়ে। একদিকে, নগরটির অভ্যন্তরে সমস্যা, পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথেও একরকম যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। অন্যদিকে প্রকৃতিও যখন বিরূপ আচরণ শুরু করলো, অ্যাংকরের জন্য টিকে থাকা আসলেও বেশ মুশকিল হয়ে পড়লো।

এদিকে যখন অ্যাংকরের এই অবস্থা, তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও প্রকৃতি বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। ঐ ত্রয়োদশ শতকেই ইউরোপে শুরু হয় প্রচণ্ড ঠাণ্ডার যুগ; এমনকি গরমকালেও শীত পড়তে থাকে। এই সময়টাকে বলা হয় ‘লিটল আইস এজ’, বাংলায় বললে ক্ষুদ্র বরফ যুগ। এশিয়াতেও প্রকৃতির থাবা পড়ে। চলতে থাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।  দুর্যোগ, খরার কারণে সম্ভবত এই সময়েই গ্রিনল্যান্ড ও মায়া নগরী ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। এসব কিছুই যেন ‘অ্যাংকর’ রাজ্যেরও শেষ পরিণতির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
এমনিভাবে নানা কারণে খেমারদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দিনদিন কমে যাচ্ছিল। ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে খেমাররাজ অযোধ্যারাজের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হতে শুরু করে। আর চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করলো ১৪৩১ সালে। আর এভাবে অ্যাংকর নগর একরকম ধ্বংসই হয়ে গেল। হারিয়ে গেল এশিয়ার আরেকটি সমৃদ্ধ নগরী অ্যাংকর।

না, শহরটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি; নগরটির অনেক স্থাপত্যই এখনো টিকে আছে, সংরক্ষিত আছে। তবে স্থাপত্যগুলো একটি দেশে না, ছড়িয়ে আছে তিন-তিনটি দেশে। বলেছিলাম না, নগরটি অনেক বড়ো ছিল; এখন বুঝলে তো, আসলে কতো বড়ো ছিল শহরটি! স্থাপত্যগুলোর বেশিরভাগই মন্দির। অধিকাংশ মন্দিরই আছে কম্বোডিয়া আর থাইল্যান্ডে। অল্প কিছু মন্দির লাওসে-ও আছে। তবে তো একটু সমস্যা-ই হয়ে গেল; অ্যাংকর নগরী, বা অ্যাংকর সভ্যতা দেখতে চাইলে তোমাকে যেতে হবে একটি নয়, দু’টি নয়, তিন-তিনটি দেশে! তবে সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দিরটি কিন্তু কম্বোডিয়ায়। কেন, ‘অ্যাংকর ওয়াত’ মন্দিরটির কথা না তোমাদেরকে বললাম? ওটা তো কম্বোডিয়াতেই। ওটা তো এখন কম্বোডিয়ার প্রতীকেই পরিণত হয়েছে। অ্যাংকর ওয়াত কম্বোডিয়ায় পর্যটকদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান-ই শুধু নয়, অ্যাংকর ওয়াত কম্বোডিয়ার জাতীয় পতাকাতেও স্থান করে নিয়েছে।

কী, অ্যাংকর সভ্যতার সুন্দর সুন্দর মন্দিরগুলো দেখতে ইচ্ছে করছে, যেগুলোতে খোদাই করা আছে নানা মূর্তি, আর আছে অপূর্ব সব ভাস্কর্য? তবে তো তোমাকে কম্বোডিয়া নয় থাইল্যান্ডে যেতে হবে। লাওসে যদি যাও, তা-ও কিছু দেখতে পাবে। আর যাওয়ার আগে আমাকে নিয়ে যেতে যেনো ভুলো না; শত হলেও, আমি-ই তো তোমাকে অ্যাংকরের খবরটা জানালাম, নাকি?

No comments:

Post a Comment