Friday, March 30, 2012

বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস

বৌদ্ধ-শিব নৈবেদ্যপাত্র
বৌদ্ধ-শিব নৈবেদ্য পাএ 

হাজার বছরের নয়, আড়াই হাজার বছরেরও প্রাচীন আমাদের সংস্কৃতি। রাজধানী ঢাকার অনতিদূর নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরে মিলেছে এমন সব নিদর্শন, যার ভিত্তিতে লিখতে হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। বিস্তারিত জানাচ্ছেন কাজল রশীদ



বৌদ্ধ-শিব নৈবেদ্য পাএ 

মানুষ একদা পাহাড়ের গুহা ও গাছের কোটরে বাস করত, যাকে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ। মানুষের প্রথম স্থায়ী বসতি ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে। ভারতের মেহেরগড়ে মিলেছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম কৃষিনির্ভর স্থায়ী বসতির নিদর্শন। উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া গেছে মাটিতে গর্ত করে বসবাসের উপযোগী ঘরের চিহ্ন গর্ত-বসতি। এখানকার দুর্গ নগরের অভ্যন্তরে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫ শতকের প্রাচীন একটি ঘরের ধসে পড়া মাটির দেয়ালের চিহ্নও পাওয়া গিয়েছে । একমাত্র উয়ারী-বটেশ্বর ছাড়া বাংলাদেশে এ ধরনের মাটির প্রাচীন স্থাপত্যের অবশেষ অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। শুধু গর্ত-বসতি নয়, উয়ারী-বটেশ্বরে মিলেছে এমন সব নিদর্শন, যা দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে, আমাদের সংস্কৃতি আড়াই হাজার বছরের পুরনো। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও এমনটিই বলেছেন: ‘পণ্ডিতেরা যখন আমাদের সংস্কৃতিকে হাজার বছরের বন্ধনীতে বেঁধে দেন, তখন অজান্তে আমার মনে এক ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস পড়ে। আজ উয়ারী-বটেশ্বর উৎখনন কাজের ফলে আমাদের সংস্কৃতি আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন হয়ে গেল।’
উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষকৃত উল্লেখযোগ্য নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে: স্বল্প- মূল্যবান পাথরের পুঁতি, নবযুক্ত মৃৎপাত্র, রাস্তা, ইটের পূর্ণ কাঠামো, বাটখারা, মৃৎপাত্র, মুদ্রা, গর্ত-নিবাস প্রভৃতি।
এসব নিদর্শনের ভিত্তিতে লেখা হচ্ছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। সূচনা করেছিলেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ পাঠান। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে উয়ারী গ্রামে শ্রমিকেরা মাটি খননকালে একটি পাত্রে কয়েকটি মুদ্রা পান, যা ছিল বঙ্গ ভারতের প্রাচীনতম রৌপ্যমুদ্রা। তিনি সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে ‘প্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তি’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যায় ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এভাবেই তিনি প্রাচীনতম নিদর্শনাদি সংগ্রহ ও লেখালেখির মাধ্যমে উয়ারী-বটেশ্বরকে প্রথম সুধী সমাজের নজরে আনেন। পরে তাঁর ছেলে হাবিবুল্লা পাঠান স্থানটির গুরুত্ব তুলে ধরে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন।
উয়ারী-বটেশ্বরের সভ্যতা ও প্রত্নবস্তু নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সোচ্চার থাকলেও উৎখনন হচ্ছিল না। অবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান-এর নেতৃত্বে ২০০০ সালে শুরু হয় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন। তাঁদের উৎখননে উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত হয়েছে এমন সব নিদর্শন, যা জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস।
এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গ-নগর, বন্দর, রাস্তা, পার্শ্ব-রাস্তা, পোড়ামাটির ফলক, স্বল্প-মূল্যবান পাথর ও কাচের পুঁতি, মুদ্রাভান্ডারসহ উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা ও আরো অনেককিছু । নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত ল্যাবরেটরিতে কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হয়। ওই পরীক্ষায় এখানকার দুর্গ-নগর বসতিকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।
উয়ারী গ্রামে ৬০০ মিটার দীর্ঘ বাহুবিশিষ্ট বর্গাকৃতি দুর্গ-প্রাচীর ও পরিখা রয়েছে। ৫.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট আরেকটি বহির্দেশীয় দুর্গ-প্রাচীর ও পরিখা সোনারুতলা গ্রাম থেকে শুরু করে বটেশ্বর, হানিয়াবাইদ, রাজারবাগ ও আমলার গ্রামের ওপর দিয়ে আড়িয়াল খা নদের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটিকে স্থানীয় লোকজন অসম রাজার গড় বলে থাকেন। এরূপ দুটো প্রতিরক্ষাপ্রাচীর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বা প্রশাসনিক কেন্দ্রের নির্দেশক, যা প্রাচীন নগরায়ণেরও অন্যতম শর্ত।
উয়ারী গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৬০মিটার দীর্ঘ, ৬ মিটার প্রশস্ত একটি প্রাচীন পাকা রাস্তা, যা নির্মাণে ব্যবহূত হয়েছে ইটের টুকরা, চুন, উত্তর ভারতীয় কৃষ্ণমসৃণ মৃৎপাত্রের টুকরা, তার সঙ্গে রয়েছে ল্যাটারাইট মাটির লৌহযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরা। এ সম্পর্কে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অভিমত, এত দীর্ঘ ও চওড়া রাস্তা এর আগে পুরো গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ সভ্যতার কোথাও আবিষ্কৃতি হয়নি। গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ বলতে সিন্ধু সভ্যতার পরের নগরায়ণের সময়কে বোঝায়। ফলে যেটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তা শুধু বাংলাদেশে নয়, সিন্ধু সভ্যতার পর ভারতবর্ষের পুরোনো রাস্তার একটি।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খা নদের মিলনস্থলের কাছে কয়রা নামের একটি নদীখাদ রয়েছে, যার দক্ষিণ তীরে গৈরিক মাটির উঁচু ভূখণ্ডে উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে স্থানটিকে আদি-ঐতিহাসিক কালপর্বের বহির্বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে অনুমিত হয়। টলেমির বিবরণ থেকে দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অনুমান, আদি-ঐতিহাসিক যুগে উয়ারী-বটেশ্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণের সওদাগরি আড়ত হিসেবে কাজ করত। তাঁর এই ধারণা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন সুফি মোস্তাফিজুর রহমান নতুন নতুন আবিষ্কারের ভিত্তিতে ।
উয়ারী-বটেশ্বরকে গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমির সৌনাগড়া বলে নির্দেশ করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী। 
উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত এক বর্ণিল টানা কাচের পুঁতি ও স্যান্ডউইচ কাচের পুঁতি থেকে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (থাইল্যান্ড) ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের (রোমান সাম্রাজ্য) বহিঃবাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান উয়ারী-বটেশ্বরকে টলেমির উল্লিখিত সৌনাগড়া বলে উল্লেখ করেছেন।
একদা হানিফ পাঠান যে কাজ শুরু করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতায় এখন প্রমাণিত যে উয়ারী-বটেশ্বরে আড়াই হাজার বছর আগে মানুষ নগর নির্মাণ করেছিল। সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর দলের উৎখনেন প্রাপ্ত নিদর্শনাদি প্রমাণ করেছে আড়াই হাজার বছর আগে উপমহাদেশে যে ষোড়শ মহাজনপদ ছিল, তারই একটি হচ্ছে উয়ারী-বটেশ্বর।

অসাধারণ ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন এই প্রত্নস্থান ও তার প্রত্নবস্তু নিয়ে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও মুহম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান রচনা করছেন উয়ারী-বটেশ্বর শেকরের সন্ধানে নামের বই, যা প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। 
বিচারপতি হাবিবুর রহমান লিখিত মুখবন্ধ এক, ক্যেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী লিখিত মুখবন্ধ দুই, প্রসঙ্গ কথাসহ বইটিতে রয়েছে মোট ২৬টি অধ্যায়। সংযোজিত হয়েছে নির্ঘণ্ট ও রঙিন আলোকচিত্র। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, বিশ্লেষণ, ঐতিহাসিক কাল-সময়-ঘটনাপ্রবাহ নিরূপণ, যুক্তি, মূল্যায়ন উপস্থাপিত হয়েছে এই বইয়ে। গ্রন্থকারদ্বয়ের শ্রমসাধ্য, গবেষণালব্ধ ওই সৃষ্টি উয়ারী-বটেশ্বরকে জানার সুযোগ তৈরি করেছে, যার মধ্যে দিয়ে যে কেউ জানতে পারবে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। যে ইতিহাসের অমর সাক্ষী উয়ারী-বটেশ্বর।
ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খা নদের তীরে অবস্থিত এই স্থান আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এক দুর্গ-নগর। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এটিকে মনে করা হচ্ছে একটি প্রাচীন নদীবন্দর। স্বল্প-মূল্যবান পাথরের পুঁতি ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হওয়ায় মনে করা হচ্ছে, এটি একটি বাণিজ্যনগর। স্থানটি বন্যামুক্ত হওয়ায় এখানে অনেক আগে বসতি স্থাপন মানুষের উন্নত পরিকল্পনা ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিচায়ক। সব মিলিয়ে উয়ারী-বটেশ্বর আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে আমাদের শেকড়ের প্রাচীন সময়কালকে, যা সাক্ষী দিচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি হাজার বছরের নয়, আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্যস্নাত। বাংলাদেশের নতুন এক ইতিহাস এ উয়ারী-বটেশ্বর, যার প্রত্নসম্পদ এখনো আবিষ্কার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তারপরও প্রাপ্ত নিদর্শনে নিশ্চিত হওয়া গেছে আমাদের সংস্কৃতির শেকড় ও তার সময়কাল সম্পর্কে।
খবর প্রথম আলো।

No comments:

Post a Comment