Monday, December 10, 2012

মানবাধিকার - বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি


আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ | তারিখ: ১০-১২-২০১২
২০১২ সালে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে কিছু ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও বিগত বছরের উদ্বেগের বিষয়গুলোর মাত্রা কমেনি, বরং নতুন কিছু ইস্যু সংযুক্ত হয়েছে। ইতিবাচক অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই বছর বেশ কিছু আইন হয়েছে, যেমন—মানব পাচার আইন, ২০১২, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২। রাষ্ট্রপতি ও সরকার কর্তৃক অপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পরীক্ষার এখতিয়ার আছে উচ্চ আদালতের—উচ্চ আদালতের এই রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ বছর সম্পূর্ণ হলো পিলখানা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার; যদিও এই বিচার-প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হলো যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত প্রধান আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং তাঁদের বিচার-প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। তবে এ বছর একটি পর্যায়ে গণতন্ত্রের অন্যতম দুটি স্তম্ভ বিচার বিভাগ ও সংসদের মুখোমুখি অবস্থান সুশাসনের নীতিকে বিঘ্নিত করেছে। সারা বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে বেআইনি গ্রেপ্তার, গুম, খুন ও বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জনসাধারণের মনে একধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। 
সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকলেও মেয়াদের শেষ বছরে এসেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। আসক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক হেফাজতে থাকা অবস্থায় বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮৬ জন। এ ছাড়া, বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে বিচার চাইতে এসে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন এক তরুণী ও তাঁর বাবা-মা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি যোগ হওয়া নতুন প্রবণতা হচ্ছে গুম ও গুপ্তহত্যা। 
বছরের সবচেয়ে আলোচিত গুমের ঘটনা ছিল একজন রাজনৈতিক নেতা এবং একজন শ্রমিকনেতার গুম হওয়া। কেবল রাজনৈতিক কারণে নয়, পারিবারিক, সামাজিক নানা দ্বন্দ্বের জের ধরেও গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০১২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অপহূত বা গুম হয়েছেন ৫৫ জন। এসব ক্ষেত্রে সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে সব দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে নানা অপ্রত্যাশিত বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত হতাশাজনক এবং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। প্রতিবেশী ভারতের বারবার আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বন্ধ হয়নি এবং এ ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। চলতি বছরে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন বাংলাদেশি। 
অন্যদিকে, প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ, যথাযথভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, রাস্তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে দায়, তা সরকার যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। এ বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সরকার কঠোরভাবে দমন করার প্রয়াস চালায়। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া হয়, বিরোধী দলের কর্মসূচিকে সামনে রেখে গণগ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিক্ষোভ সমাবেশে, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির শোভাযাত্রা এবং পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে। তবে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা বহাল রাখার দাবিতে ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন দমনে প্রথম দিকে কঠোর অবস্থান নেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের দাবি মেনে নেওয়া একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বর্তমানে গণমাধ্যমগুলো আপাত স্বাধীনতা ভোগ করলেও নীরব নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। টিভি টক শোর ব্যাপারে সরকারের আপত্তি, বিরোধী দলের সমাবেশের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া এবং ইন্টারনেট, ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। 
মহাজোট সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। এ বছরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এ সময়ে শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতায় প্রাণ হারান অনেক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, বিশেষত বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি দমনে ছাত্রলীগকে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনকে দলীয়করণের কারণে সারা বছর কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অসন্তোষ বিরাজ করেছে। আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ২০১২ সালের এপ্রিলে করাইল বস্তি থেকে এক দিনেরও কম সময়ের নোটিশে কোনোরকম পুনর্বাসনের পরিকল্পনা ছাড়াই প্রায় দুই হাজার লোককে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ বছরেও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত ছিল। আহমদিয়া সম্প্রদায়কে মসজিদ নির্মাণ, সভা আয়োজনে বাধা দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে, দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর আক্রমণ হয়। এ বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি ও বৌদ্ধমন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং লুটের মাধ্যমে। এ সময় পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। এই ঘটনায় সাতটি বৌদ্ধমন্দির সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়ে যায়। আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৩টি মন্দির। পুড়ে যায় কিংবা লুট হয় মূল্যবান প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি ও সম্পদ।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও সরকার আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি বসতি স্থাপনকারী, সেনাবাহিনীর সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা আদিবাসীদের ওপর হত্যা, নির্যাতন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান, নারী ও শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতা, ভূমি দখল ইত্যাদির অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর। বিশ্ব আদিবাসী দিবসে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার সূত্র ধরে আদিবাসীদের সভা ও শোভাযাত্রা করার ক্ষেত্রে সরকারি নিষেধাজ্ঞার অভিযোগ রয়েছে। 
বছরের শেষ দিকে এসে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস নামের পোশাক কারখানায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয় ১১১ জন পোশাকশ্রমিক এবং আহত হয় আরও শতাধিক। এ ক্ষেত্রে কারখানার মালিক ও সরকার শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান ও তা পর্যবেক্ষণ এবং সংরক্ষণে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে মানবাধিকারের দিকগুলো বিশেষভাবে স্থান পেলেও গত চার বছরে তার প্রতিফলন ঘটেছে খুব কম। সরকারের শেষ এক বছরে এ ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রগতি সাধিত হয়, তা এখন দেখার বিষয়। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক): স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন।


No comments:

Post a Comment